অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা: অর্থনীতি হলো এমন একটি পরিবর্তনশীল সামাজিক বিজ্ঞান যা মানুষের আয় ও এর বণ্টন, কর্মসংস্থান, মানবিক কল্যাণ এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহার উপযোগী সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পথ নির্দেশ করে। সমাজবদ্ধ মানুষের সকল অর্থনৈতিক কাজকর্ম অর্থনীতির আওতাভুক্ত বলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নিকট এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
রবিনস্ প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এল রবিনস্ ১৯৩১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Nature and Significance of Economics ‘Science‘ গ্রন্থে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেন। রবিন্স অর্থনীতির সংজ্ঞায় বলেন, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনমূলক কার্যাবলি আলোচনা করে।”
অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা
অর্থনীতি মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের উপায় বা পথ নির্দেশ করে। তাই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিচে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো-
১. সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ব্যবহার: সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত অর্থনীতির একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়। সীমিত সম্পদের বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়া যায় তার সার্বিক জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিহার্য।
২. অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসঙ্গ: কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদিশিক বাণিজ্য প্রসারের জন্য অর্থনীতির পাঠ গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সাথে সাথে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার এবং বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: দেশের বর্তমান মৌলিক অর্থনীতির সূচকসমূহ পর্যালোচনা করে অর্থনীতির উন্নয়ন সুনিশ্চিত এবং সুসংহতকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ প্রণয়নের ক্ষেত্রেও অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণ, অর্থনীতি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন বিভাগের তাত্ত্বিক উপকরণের মাধ্যমে আলোচনা করেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
৪. পারিবারিক চাহিদা পূরণ: অর্থনীতির মৌলিক সমস্যা হচ্ছে সীমিত সম্পদ ও অসীম অভাবের সমন্বয় সাধন। তাই পারিবারিক জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য কীভাবে সীমিত সম্পদকে সঠিকভাবে, বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরিতুষ্টি বিধান করা যায় তার জন্য অর্থনীতি পাঠ অত্যন্ত আবশ্যক।
৫. রাষ্ট্র পরিচালনা: রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের এবং রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ সাধন। জনগণের জন্য কর্মসংস্থান, সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা, আয় ইত্যাদি নিশ্চিত করা। তাই সরকারি আয়-ব্যয় নির্ধারণ, বাজেট প্রণয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতি রোধ, উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নিশ্চয়তার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অর্থনীতি পাঠ আবশ্যক।
৬. রাজনীতি চর্চা: রাজনীতি চর্চার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের সার্বিক মঙ্গল সাধন করা। জনগণ বা রাষ্ট্রের কল্যাণ সুসংহতকরণের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। সুতরাং রাজনীতিবিদগণের যদি অর্থনীতি পাঠের অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তারা প্রয়োজনীয় সময়ে উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও নিশ্চিত করতে পারবে।
৭. সম্পদের পরিকল্পিত ব্যবহার: অর্থনৈতিক সাফল্য বা প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রেই সম্পদ পরিকল্পিত ব্যবহারে পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থনীতির পাঠ মানুষকে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের সর্বোত্তম এবং বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ফলে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় জীবনে এই জ্ঞান সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। সুতরাং অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্যও অর্থনীতির পাঠ গুরুত্বপূর্ণ।
৮. চিন্তার পরিধি বিস্তৃতকরণ: অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান ‘যা’ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে বাস্তব জীবনের ব্যবহারিক বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে। যারা এই অর্থনীতির চর্চার সাথে যুক্ত তারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ ও সমাধানের প্রয়াস চালায় যা মানুষের চিন্তার পরিধি বিস্তৃতকরণে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
৯. খাজনা ও মজুরি নির্ধারণ: রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রথম এবং প্রধান উৎস হচ্ছে খাজনা। সঠিক উপায়ে খাজনা আদায় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ ও উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির খাজনাতত্ত্ব বিষয়ক পাঠ বিশেষ প্রয়োজনীয়। অপরপক্ষে, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ এবং তা সুষ্ঠুভাবে প্রদানের জন্য এবং তাদের আরও উৎপাদন ব্যবস্থা সুসংহত করণের জন্যও অর্থনীতি পাঠ বিশেষ আবশ্যক।
১০. সামাজিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য অর্থনীতি পাঠ অত্যাবশ্যক। অর্থনীতি উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নৈতিক-অনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রতিরোধের ব্যাপারে দায়িত্বশীল করে তোলে। যার ফলে ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত সম্ভব হয়।
উপসংহার: সুতরাং ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে, সর্বস্তরে মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনীতি পাঠ অতি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি পাঠ মানুষকে দায়িত্বশীল এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
আরও দেখুন: অধ্যাপক এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞাটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
আরও দেখুন: অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞাটি বৈশিষ্ট্যসহ ব্যাখ্যা দাও
আশাকরি “অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।