অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে কী বোঝ: অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক দেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলি সেদেশের প্রতিষ্ঠানগত ও আইনগত কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানগত ও আইনগত কাঠামোকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত চার ধরনের অর্থব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা অন্যতম।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: যেকোনো দেশ বা অর্থনীতি সে দেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালনার জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠানগত ও আইনগত কাঠামো অনুসরণ করে। আর এ প্রতিষ্ঠাগত ও আইনগত যে কাঠামো রয়েছে তাকেই ঐ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চার ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, মিশ্র এবং ইসলামি অর্থব্যবস্থা।
অর্থনীতিবিদ জি. গ্রোসম্যান এর ভাষায়, “মানুষ যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে তা দ্বারাই মানুষের সব অর্থনৈতিক কার্যাবলি তথা উৎপাদন, ভোগ, বিনিময়, বণ্টন প্রভৃতির প্রকৃতি ও পদ্ধতি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।” সুতরাং বলা যায়, মানুষ যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও বিধিব্যবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালনা করে তাকেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে।
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় থাকে এবং সমাজের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেসরকারি পর্যায়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংঘটিত হয়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
১. সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা: সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ধন সম্পদ এবং অধিক আয়ের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে অধিক পরিশ্রম করতে অনুপ্রাণিত করে। ব্যক্তির এ আকাঙ্ক্ষার দরুন সমাজও লাভবান হয়। সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় সব ব্যক্তিই সর্বাধিক উৎপাদন করতে সচেষ্ট হয়। ফলে সমাজের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২. উদ্যোগের স্বাধীনতা: উদ্যোগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা এবং শ্রম ও মূলধনের অবাধ গতিশীলতা। কোন দ্রব্য কখন, কীভাবে উৎপাদন করা হবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এসব ক্ষেত্রে সরকার অবাধ নীতি অবলম্বন করে। এজন্য ধনতন্ত্রকে স্বাধীন উদ্যোগের অর্থনীতি বলা হয়।
৩. ভোক্তার সার্বভৌমত্ব: ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ভোক্তাগণ স্বাধীনভাবে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে ভোগ করতে পারে। ভোক্তাগণ ইচ্ছামত পণ্যসামগ্রী বাছাই করে তা ক্রয় করে থাকে। তাদের এ কাজে সরকার বা অন্য কেউ বাধা প্রদান করে না। ভোক্তাদের পছন্দমত সমাজে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়। ভোক্তাগণের পছন্দ বা চাহিদামতো উৎপাদনকারীগণ পণ্য উৎপাদন করে থাকে। পণ্য বাজারের ভোক্তাগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
৪. স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা: ধনতন্ত্রের অপর বৈশিষ্ট্য হলো নিয়ন্ত্রণবিহীন ও স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা। দামব্যবস্থা সরকার বা কোনো পরিকল্পনা বিভাগ পরিচালনা করে না। এক্ষেত্রে দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয়। সুতরাং ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সকল অর্থনৈতিক কাজকর্ম স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়।
৫. প্রতিযোগিতা: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দাম, খাজনা, মজুরি, সুদ, মুনাফা প্রভৃতি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রতিযোগিতার উপস্থিতি এ জাতীয় অর্থব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
৬. সমাজের শ্রেণিবিভাগ: ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে এখানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এরকম বিভিন্ন শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সমাজে সাধারণত উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকেরা অর্থনীতি ও সমাজের ওপর প্রভাব বজায় রেখে অধিকতর সম্পদ আহরণে লিপ্ত থাকে এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকেরা বিত্তহীন অবস্থায় সর্বদা কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে।
৭. ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: ধনতন্ত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। দেশের প্রত্যেক নাগরিক তার ব্যক্তিগত সম্পদ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহারের স্বাধীনতা রাখে। তাছাড়া ব্যবসায়ে সম্পদ বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেকোনো প্রকার চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রেও সকল নাগরিকেরই পূর্ণ স্বাধীনতা বিদ্যমান।
৮. উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও পরিচালনা: ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা ব্যক্তিবিশেষের হাতে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন নাগরিকগণ ব্যক্তিগতভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মুনাফা ও লোকসানের দিকে নজর রেখে এসব প্রতিষ্ঠান তারা নিজেরাই পরিচালনা করে থাকেন।
৯. মুনাফা: মুনাফাই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। মুনাফাকে কেন্দ্র করে সমস্ত উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। যেসব দ্রব্য উৎপাদনে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব উদ্যোক্তাগণ সেসব দ্রব্য উৎপাদনে মূলধন বিনিয়োগ করে। এরূপ বিনিয়োগের ওপরই কর্মসংস্থান, কার্যকর চাহিদা ও জাতীয় আয় নির্ভরশীল।
১০. আয় বণ্টনের অসামঞ্জস্য: ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্ব বিরাজমান। মালিকশ্রেণি মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে আর শ্রমিকগণ শ্রমের বিনিময়ে শুধু নির্দিষ্ট মজুরি অর্জন করে। এভাবে সমাজে আয়ের অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়।
উপসংহার: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যক্তিগত কর্ম উদ্যোগের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এ প্রক্রিয়াটিতে কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা থাকে না। এ ব্যবস্থা মূলত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ভোগ প্রভৃতি পর্যায়গুলো স্বয়ংক্রিয় মূল্যব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আরও দেখুন: অধ্যাপক এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞাটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
আরও দেখুন: অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞাটি বৈশিষ্ট্যসহ ব্যাখ্যা দাও
আরও দেখুন: অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর
আরও দেখুন: মানুষ কীভাবে সীমিত সম্পদের সাহায্যে অসীম অভাব পূরণ করে তা আলোচনা কর
আশাকরি “ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।