বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব বর্ণনা কর: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বহুলাংশে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অথচ এসব নদনদী বারোমাসই নাব্য থাকে। এদেশে সর্বত্র পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদী এবং এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখা নদী রয়েছে। নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে এসব নদনদী ৮,৪৩১ কিলোমিটারই নাব্য রয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথই যাতায়াত ও পরিবহনের প্রধান মাধ্যম।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব
নদীমাতৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় নৌ পরিবহনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশের সড়ক ও নৌ পথ উন্নত নয় বলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের অধিকাংশই নদীপথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। নিচে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো-
১. স্বল্প ব্যয়ে পরিবহন: যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে সুলভ পরিবহন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে জলপথ খুবই সুলভ। এ কারণে দেশের ৭৫ ভাগ অভ্যন্তরীণ যাত্রী ও বাণিজ্য পরিবহন কাজ নৌপথেই সম্পাদিত হয়ে থাকে।
২. আর্থিক দিক হতে জলপথ: নৌপথ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো খরচ নেই বললেই চলে। অথচ রেল ও সড়কপথের জন্য কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। তাই নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ থেকে বহু টাকা রাজস্ব সঞ্চয় হয়।
৩. একমাত্র অবলম্বন: বাংলাদেশের অনেক স্থান আছে যেখানে সড়ক ও রেলপথ নেই। সেসব স্থানে নৌপরিবহন ব্যবস্থাই একমাত্র অবলম্বন। এছাড়া বন্যার সময় রাস্তাঘাট ডুবে গেলে নৌপথই চলাচল ও পণ্য পরিবহনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।
৪. ভারি পণ্য পরিবহন: ভারি পণ্যসামগ্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে জলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহজ ও সুলভে ভারি পণ্য স্থানান্তরিত করতে একমাত্র জলপথই শ্রেয়। অন্যান্য পথে ভারি বস্তু স্থানান্তর খুবই কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ব্যাপার।
৫. কৃষি উন্নয়ন: ‘কৃষিক্ষেত্রে বীজ, সার, যন্ত্রপাতি, শ্রমিক প্রভৃতি নিয়ে যাওয়া এবং সেখান হতে উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণে সুলভ পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। তাই সুলভ জলপথ কৃষির উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে থাকে।
৬. শিল্পোন্নয়ন: সুলভ জলপথ ছাড়া কোনো দেশই শিল্পকারখানায় উন্নতি লাভ করতে পারে না। কারণ শিল্পকেন্দ্রে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং শিল্পজাত দ্রব্য দেশ-বিদেশের বাজারে প্রেরণের জন্য এটিই সুলভ পথ। বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নেও জলপথের ভূমিকা প্রধান।
৭. ব্যবসায়-বাণিজ্য: নদীমাতৃক বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য নদীপথের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। সুলভ নৌপথ ছাড়া কোনো দেশই ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করতে পারে না। আবার ব্যবসায়-বাণিজ্য ছাড়া কোনো দেশই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নতি লাভ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতির মূলে রয়েছে নদীপথ।
৮. বন্যার তীব্রতা হ্রাস: দেশে রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণ করলে অনেক ক্ষেত্রে পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশে বন্যা হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু দেশে জলপথের সংখ্যা বেশি থাকলে সত্বর পানি সরে যেতে পারে। এর ফলে বন্যার তীব্রতা হ্রাস পায়।
৯. জাতীয় আয় বৃদ্ধি: নৌপথের মাধ্যমে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকে। ফলে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। এতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়।
১০. মৎস্য সম্পদ সংগ্রহ: বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ সংগ্রহে নৌপরিবহন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের জাহাজগুলো দিয়ে মৎস্য শিকার এবং ধৃত মৎস্যগুলো বাজারজাতকরণের জন্য মৎস্যকেন্দ্রে মাছ সরবরাহ করা যায়। মৎস্য সম্পদ সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে জলপথই একমাত্র উত্তম মাধ্যম।
১১. দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা: দেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ কিংবা বহিঃশত্রুর আক্রমণে সড়ক ও রেলপথ নষ্ট হয়ে গেলেও নৌপথ নষ্ট হওয়ার নয়। তাই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নৌপথের গুরুত্ব অপরিসীম। নৌপথের মাধ্যমেই বাংলাদেশের নৌবাহিনী সার্বক্ষণিক দেশরক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে।
১২. বেকার সমস্যার সমাধান: বাংলাদেশ নৌপরিবহনের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত থেকে বহুলোক তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। মৎস্য শিকার থেকে শুরু করে ধৃত মৎস্য বাজারজাতকরণে প্রচুর লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ সংস্থার সাথে জড়িত আছে।
উপসংহার: সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের যোগাযোগ ও বাণিজ্য অনেকটাই জলপথের ওপর নির্ভরশীল। জলপথে পরিবহন ব্যবস্থা সহজ, স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ, স্বল্প ঝুঁকি ইত্যাদি সুবিধার কারণে নৌপথে বাংলাদেশের অধিকাংশ পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করে থাকে। সুতরাং দেশের সার্বিক উন্নয়নে জলপথের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আরও দেখুন: উপযোগ কাকে বলে? ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধিটি ব্যাখ্যা কর
আরও দেখুন: উৎপাদন কাকে বলে? উৎপাদনের উপকরণসমূহ বর্ণনা কর
আরও দেখুন: রেখাচিত্রের সাহায্যে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটি ব্যতিক্রমসহ ব্যাখ্যা কর
আরও দেখুন: অর্থনীতিতে বাজারের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর
আরও দেখুন: একচেটিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
আশাকরি “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব বর্ণনা কর” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।