বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান: অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যসংবলিত মানুষের যাবতীয় কার্যক্রম হলো ব্যবসায়। ব্যবসায়ের ইংরেজি শব্দ “Business” যার পুঁথিগত অর্থ হলো কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা। ব্যবসায় বা ব্যবসায়ী মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই কারবারি লেনদেন সম্পাদনে ব্যস্ত থাকে। আর যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক সমৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ভূমিকা অপরিসীম।
ব্যবসায়ের সংজ্ঞা: সাধারণত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পণ্যদ্রব্য, শ্রম ও সেবাকর্মের উৎপাদন, বণ্টন এবং এদের সহায়ক যাবতীয় বৈধ কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলে। অন্যভাবে বলা যায়, উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, ঝুঁকি গ্রহণ, ব্যাংকিং, সংগঠন, প্রচার, মতামত প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য, শ্রম ও সেবাকর্ম গ্রাহকের মধ্যে বিতরণ করে প্রত্যক্ষভাবে মালিকের জন্য মুনাফা অর্জন এবং পরোক্ষভাবে জনগণের সেবা প্রদান করাকে ব্যবসায় বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
1. Roger W. Babson-এর মতে, “মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য সেবাকর্ম ও মতাদর্শ উৎপাদন, বণ্টন এবং এদের সহায়ক মানুষের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলা হয়।”
2. Prof. Norman Richard Owens-এর মতে, “ব্যবসায় হলো একটি প্রতিষ্ঠান যা বাজারে বিক্রয়ের নিমিত্ত পণ্যদ্রব্যাদি উৎপাদন ও বণ্টনে লিপ্ত অথবা মূল্যের বিনিময়ে সেবাদানে নিয়োজিত।”
3. Y.K. Bhushan বলেন, “ব্যবসায় বলতে পণ্যদ্রব্যের সংগঠিত উৎপাদন বা বিক্রয়ের কাজকে বোঝায় যা মানুষের অভাব পূরণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে গৃহীত বা সম্পাদিত হয়।”
4. L.H. Haney-এর মতে, “পণ্যসামগ্রী ক্রয় বা বিক্রয়ে সম্পদ উৎপাদন অথবা সংগ্রহের জন্য মানুষের কার্যকলাপকে ব্যবসায় বলে।”
5. Prof. M.C Sukla-এর মতে, “মুনাফা অথবা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে সম্পদ উৎপাদন, ক্রয় ও বণ্টনের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলে।”
সুতরাং বলা যায়, মুনাফা অর্জন এবং সমাজসেবার উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন ও বণ্টন এবং এদের সহায়ক যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রম ও সেবাকর্ম এবং মতাদর্শ বিনিময়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন সম্পর্কিত মানুষের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির পাশাপাশি ব্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমেই কৃষিপণ্যসমূহ ভোক্তাদের নিকট সরবরাহ করা হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণেই পৃথিবীর বহু দেশ উন্নতির উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা অবদান আলোচনা করা হলো-
১. উৎপাদনে সাহায্য: বাংলাদেশে ব্যবসায় উৎপাদন কাজে সহায়তা করে থাকে। ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য উৎপাদনকারিগণ নিশ্চিতভাবে পণ্য উৎপাদন করে থাকে। উৎপাদনকারীকে পণ্য বিক্রির ঝামেলা পোহাতে হয় না। সুতরাং ব্যবসায় পণ্য উৎপাদনে উৎপাদনকারীকে সাহায্য করে থাকে।
২. বণ্টনে সহায়তা: ব্যবসায় এদেশের উৎপাদনকারীদের নিকট হতে পণ্য সংগ্রহ করে তা ভোক্তাদের নিকট বণ্টন করে থাকে। এর ফলে এখানকার ভোক্তাগণ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ পায়।
৩. মালিকানাগত উপযোগ সৃষ্টি: পণ্যসামগ্রীর মালিকানাগত উপযোগ সৃষ্টিতে ‘বাংলাদেশে ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যবসায়ের মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। পণ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার সমস্যার সমাধান করে ব্যবসায় মালিকানাগত উপযোগ সৃষ্টি করে।
৪. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি: বাংলাদেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো অজস্র লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যথেষ্ট অবদান রাখছে। ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যাবলিতেই বহুলোকের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে।
৫. জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি: ব্যবসায়ের বিভিন্ন স্তরে বহুলোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে এদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
৬. চাহিদা পূরণ: ব্যবসায়িক কার্যক্রম দ্বারা বাংলাদেশে ভোক্তাদের চাহিদামতো পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে ভোক্তাগণ তাদের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হয়।
৭. জাতীয় আয় বৃদ্ধি: ব্যবসায়ের একটি শাখা শিল্পের মাধ্যমে প্রকৃতি প্রদত্ত দ্রব্যাদির বহুমুখী উপযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এজন্য বহু লোকের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ ব্যবসায়ে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়। কর্মসংস্থানের ফলে মাথাপিছু আয় বাড়ে। ফলে এদেশের জাতীয় আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
৮. ঘাটতি পূরণ: বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলে পণ্যসামগ্রীর ঘাটতি দেখা দিলে তা ব্যবসায় কার্যক্রম দ্বারা পূরণ করা হয়। সুতরাং ব্যবসায় পণ্যের ঘাটতি পূরণ করে এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
৯. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন: ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বৈদেশিক ব্যবসায়ের উদ্ভব ঘটে এবং বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের পণ্য ও সেবার বিনিময় হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে।
১০. কার্যাবলির সম্প্রসারণ: ব্যবসায়ের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়িক অন্যান্য কার্যাবলি; যেমন- বিমা, ব্যাংকিং, বিজ্ঞাপন, গুদামজাতকরণ, পরিবহন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি সম্প্রসারণে ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: ব্যবসায়িক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
১২. শিল্পের অগ্রগতি: শিল্পের অগ্রগতিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিল্পজাত দ্রব্যসমূহ ব্যবসায়ের মাধ্যমে ভোক্তাদের নিকট প্রেরণ করা হয়। ফলে শিল্পপণ্যের বাজার উন্নত হয় এবং শিল্পের অগ্রগতি সাধিত হয়।
উপসংহার: ব্যবসায় যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহে ব্যবসায় গোটা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিরূপে কাজ করে। ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়া বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অচল। কারণ ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যতীত উৎপাদক যেমন তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে না, তেমনি ভোক্তাও কাঙ্ক্ষিত পণ্য ভোগ করতে পারবে না। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা অবদান সীমাহীন।
✔ আরও দেখুন: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর
আশাকরি “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।