বাংলাদেশের রেল পরিবহনের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর: বর্তমানে বাংলাদেশের রেলওয়ে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। অনুন্নত টেলিযোগাযোগ, নড়বড়ে রেললাইন, মান্ধাতার আমলের সিগন্যাল, ইঞ্জিন ও বগির অভাব, নোংরা পরিবেশ, স্টেশনে ভিড়, স্লিপারের অভাব, পাথরের অভাব প্রভৃতি সমস্যা বাংলাদেশের রেলওয়েতে বিরাজমান। ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা বড় বাধাস্বরূপ।
বাংলাদেশের রেল পরিবহনের সমস্যাসমূহ
বাংলাদেশের রেলপথ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত থাকায় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ এ সমস্যাগুলো রেলওয়ের কার্যকারিতা, ব্যয় ও রাজস্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নিচে বাংলাদেশের রেলপথের প্রধান প্রধান সমস্যা উল্লেখ করা হলো-
১. পাথুরের অভাব: রেলওয়ে ট্রাকের নিচে ৮” পাথরের প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে আছে ৪” পাথর। ফলে রেললাইনের শক্তি কমে যায়।
২. পুরনো রেল ট্রাক: নিয়ম অনুযায়ী ৪০ বছর অন্তর ট্রাকগুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের রেল ট্রাকগুলো ৬০-৭০ বছর পার হয়ে গেলেও পরিবর্তন করা হচ্ছে না।
৩. সিগন্যাল সিস্টেম মান্ধাতার আমলের সিগন্যাল: মান্ধাতার আমলের সিগন্যাল সিস্টেম বাংলাদেশে এখনও চালু রয়েছে। এতে ট্রেন চলাচলের বিঘ্ন ঘটে থাকে।
৪. ইঞ্জিনের অভাব: একই ইঞ্জিন দ্বারা বিশ্রামহীনভাবে অনেক সময় পর্যন্ত গাড়ি চালাে । হয় বলে পথেই ইঞ্জিন ফেল করে।
৫. বগির অভাব: বগির স্বল্পতার জন্য ব্যবহারের অযোগ্য বগি দ্বারা অনেক বছর ধরে ট্রেন চালানো হচ্ছে।
৬. স্লিপারের অভাব: দুর্ঘটনা এড়াতে হলে প্রতি ৮-১০ বছর অন্তর অন্তর স্লিপারগুলো পরিবর্তন করা আবশ্যক। কিন্তু স্লিপারের অভাবের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না।
৭. অনুন্নত টেলিযোগাযোগ: বাংলাদেশের রেলওয়ের নিজস্ব টেলিযোগাযোগ নেই। ফলে দুর্ঘটনা ও চুরি-ডাকাতির সময় নিরাপত্তা অফিসের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।
৮. ওয়াগনের অভাব: রেলওয়ের পরিবাহিত পণ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সে অনুপাতে ওয়াগনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
৯. সুযোগ-সুবিধার অভাব: রেলওয়েতে যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব অধিক পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। যাত্রীরা এতে বিশেষ অসুবিধা ভোগ করে।
১০. অত্যধিক ভিড়: ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি অপেক্ষা:যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ফলে ট্রেনগুলোতে যাত্রীদের অসম্ভব ভিড় পরিলক্ষিত হয়।
১১. বিনা টিকিটে ভ্রমণ: অধিকসংখ্যক যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণের ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১২. দক্ষ কর্মচারীর অভাব: রেল কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশ রেলওয়েতে দক্ষ কর্মচারীদের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
১৩. দুর্ঘটনা: রেলপথের খারাপ অবস্থা ওরেল কর্মচারীদের অদক্ষতার জন্যই প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
১৪. দুর্নীতি: যাত্রী ও রেল কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১৫. পরিকল্পনার অভাব: সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে।
১৬. মূলধনের অভাব: বাংলাদেশ রেলওয়ে উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন তা বরাদ্দ করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন বাংলাদেশের নেই।
১৭. চুরি-ডাকাতি: বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রায় চুরি-ডাকাতি হয়ে যায়।
১৮. অবৈজ্ঞানিকভাবে টিকিট সংগ্রহ: অবৈজ্ঞানিকভাবে টিকিট সংগ্রহ করা হয় বলে অনেক যাত্রী টিকিট চেক করার সময় পালিয়ে যায়।
১৯. যাত্রী ও জনগণের উদাসীনতা: চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি চোখের সামনে দেখেও যাত্রী ও জনগণ প্রায়ই এ ব্যাপারে উদাসীন থাকেন।
বাংলাদেশের রেলপথের সমস্যা সমাধানের উপায়
বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। রেলপথ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যে রেলপথের ভূমিকা অপরিসীম। তাই বাংলাদেশ রেলওয়ে যেসব সমস্যায় জর্জরিত তার আশু সমাধান একান্ত দরকার। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে। করলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সমস্যাগুলো সমাধান করা যেতে পারে-
১. রেলওয়ের আধুনিকীকরণ: রেলওয়ের আধুনিকীকরণের ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে ব্যবস্থা আমাদেরকেও গ্রহণ।
২. সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি: যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নতুন রেলগাড়ি প্রচলন, প্ল্যাটফর্ম, ছাউনি নির্মাণ, গাড়িতে পায়খানা প্রস্রাবখানার উন্নতি সাধন, উন্নত খাবারের ব্যবস্থা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে করতে হবে।
৩. ওয়াগন আমদানি: দেশে অধিকসংখ্যক যাত্রীবাহী রেল ও মালবাহী ওয়াগন আমদানি করতে হবে।
৪. এক্সপ্রেস ট্রেন চালু: ইতোমধ্যে প্রায় ১০টি এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয়েছে।
৫. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: বাংলাদেশ রেলওয়ের সংস্কার, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের প্রয়োজন।
৬. বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধ: রেলওয়েতে যাত্রীরা যাতে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করতে না পারে তার জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অবশ্যই হাতে নিতে হবে।
৭. পারিশ্রমিক প্রদান: রেল কর্মচারীদের জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য বজায় রেখে পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।
৮. দুর্নীতি দমন: রেল কর্মচারীদের দুর্নীতি অবশ্যই দমন করতে হবে।
৯. দক্ষ প্রশাসন: বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রশাসনের সর্বস্তরে দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করে দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
১০. বাজেট বৃদ্ধি: রেলওয়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
১১. যন্ত্রপাতির সুষ্ঠু সংরক্ষণ ব্যবস্থা’: ইঞ্জিন, রেলগাড়ি, রেললাইন ও রেলওয়ের অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রভৃতির সুষ্ঠু সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. দুর্ঘটনা হ্রাস: বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেলওয়ের উন্নয়ন সাধন করে এবং সর্বোপরি রেল কর্মচারীদের সততা ও দায়িত্ব জ্ঞান বাড়িয়ে দুর্ঘটনা হ্রাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৩. বৈজ্ঞানিকভাবে টিকিট সংগ্রহ: যাত্রীদের কাছ হতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে টিকিট সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৪. টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা: আলাদাভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
১৫. বৈজ্ঞানিক সিগন্যাল সিস্টেম: স্টেশনগুলোতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সিগন্যাল সিস্টেম চালু করতে হবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান সমস্যাগুলো আশু সমাধান হবে।
আরও দেখুন: উৎপাদন কাকে বলে? উৎপাদনের উপকরণসমূহ বর্ণনা কর
আরও দেখুন: রেখাচিত্রের সাহায্যে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটি ব্যতিক্রমসহ ব্যাখ্যা কর
আরও দেখুন: অর্থনীতিতে বাজারের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর
আরও দেখুন: একচেটিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
আরও দেখুন: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব বর্ণনা কর
আরও দেখুন: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেলপথের গুরুত্ব
আশাকরি “বাংলাদেশের রেল পরিবহনের সমস্যাসমূহ” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।