লজিস্টিক সাপোর্ট এর সুবিধাসমূহ কি কি?

লজিস্টিক সাপোর্ট এর সুবিধাসমূহ: যে-সব উপকরণ বা মাধ্যমে সরবরাহকারীর কাছ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদনের স্থানে (Production place) অর্থাৎ কারখানায় (Factory) আনয়ন করা হয়, এরপর উৎপাদিত পণ্য উৎপাদন স্থান থেকে পুনঃবিক্রেতার হাত হয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো হয়, সে-সব উপকরণ বা মাধ্যমকে লজিস্টিকস সাপোর্ট বলে।

আরও সহজভাবে বলা যায়, পরিবহনের মাধ্যমে কাঁচামাল (Raw materials) সরবরাহকারীর কাছ থেকে উৎপাদনের জন্য কারখানায় (Factory) আনা হয়। কারখানায় উৎপাদিত ভোগের উপযোগী চূড়ান্ত পণ্যগুলো (Final goods) সাথে সাথে বাজারজাতকরণ না করে গুদামজাতকরণ (Warehousing) করা হয়। এরপর প্রয়োজনমতো গুদাম থেকে পরিবহনের মাধ্যমে পণ্য পুনঃবিক্রেতার (Reseller) হাত হয়ে চূড়ান্ত ভোক্তার কাছে পৌঁছানো হয়। এখানে বাজারজাতকরণ কাজে সহযোগী উপাদান যেমন- পরিবহন, গুদামজাতকরণ, প্যাকেজিংকে মার্কেটিং লজিস্টিকস সাপোর্ট বলা হয়।


লজিস্টিক সাপোর্ট এর সুবিধাসমূহ

১। কাঁচামাল সংগ্রহ: উৎপাদনের মূল উপাদান হচ্ছে কাঁচামাল। বিশ্বায়নের এই যুগে কাঁচামাল শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সারা বিশ্বের, (Whole world) যে-কোনো দেশ থেকে কম খরচে মানসম্মত কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। পরিবহন ব্যবস্থা না থাকলে কাঁচামাল কোনোভাবেই কারখানায় আনা সম্ভব হতো না। অর্থাৎ, উৎপাদনই বন্ধ থাকত। আর উৎপাদন বন্ধ থাকলে ক্রেতার কোনো অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে না। তখন সমগ্র বিশ্ব অচল হয়ে পড়বে।

২। কাঁচামালের গুদামজাতকরণ: পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগৃহীত কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য একসাথে (At a time) ব্যবহার করা হয় না। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনমতো কাঁচামাল গুদাম থেকে সংগ্রহ করে উৎপাদন কার্য চালিয়ে যাওয়া হয়। কাঁচামালের গুদামজাতকরণ না করলে যত্রতত্র ফেলে রাখলে কাঁচামাল নষ্ট হবে। এতে করে খরচ বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া প্রতিদিন কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদন করাও অসম্ভব। তাই কাঁচামালের গুদামজাতকরণ না করলে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এতে করে পণ্যের বাজার হারাতে হবে।

৩। চূড়ান্ত পণ্য পরিবহন: চূড়ান্তভাবে ব্যবহারের উপযোগী পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েই কেবল প্রতিষ্ঠানের সকল খরচ নির্বাহ করা ও মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। চূড়ান্ত পণ্য গুদামে বছরের পর বছর পড়ে থাকলে শুধুই খরচ বাড়বে। ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে না পারলে ক্রেতা হারাতে হবে। ক্রেতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানটি কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। তাই চূড়ান্ত পণ্য ভোক্তাদের কাছে পরিবহনের মাধ্যমেই বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।

৪। চূড়ান্ত পণ্যের গুদামজাতকরণ: প্রতিদিনের পণ্য প্রতিদিন উৎপাদন করে ভোক্তাদের কাছে পৌছিয়ে বাজারজাতকরণ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। অন্তত নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎপাদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠান চলবে এ পরিমাণ পণ্য গুদামজাত করে রাখতে হয়। পণ্য গুদামজাত করে না রাখলে এবং সঠিক সময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য উপস্থাপন না করলে পণ্যের ক্রেতা হারাতে হবে। আর ক্রেতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানও এক সময় অচল হয়ে পড়বে।

৫। নিয়মিত পণ্য সরবরাহ: পণ্য উৎপাদন করে গুদামজাতকরণ করতে হয়। অতঃপর গুদাম থেকে এই পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতার দোকানে পৌছে দিতে হয়। এখান থেকে ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনমতো পণ্য ক্রয় করে থাকে। আধুনিক যুগের ক্রেতারা খুবই সময় সচেতন, ব্র্যান্ড সচেতন। ফলে পণ্যসামগ্রী খুচরা বিক্রেতার দোকানে না থাকলে ক্রেতারা অন্য ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাই কোনো কারণেই পণ্য দেরিতে (Late) সরবরাহ করা যাবে না। নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করতে লজিস্টিকদের গুরুত্ব অদ্বিতীয়।

৬। ক্রেতা সেবা নিশ্চিত: ক্রেতাদের জন্য ভালোমানের পণ্য তৈরি করতে হয়। এই মানসম্মত পণ্য কম খরচে, কম সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের হাতের নাগালে (Near hand) পৌঁছিয়ে দিতে হয়। পণ্য সবসময় খুচরা বিক্রেতার দোকানে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ রাখতে হয়, যাতে কোনো সময়েই পণ্যের ঘাটতি (Shortage) না হয়। বাজারজাতকরণ লজিস্টিকসের মাধ্যমে এভাবে ক্রেতা সেবা নিশ্চিত করা হয়।

৭। বিশ্বব্যাপী বাজারজাতকরণের সুযোগ: আজ যে দেশে পণ্য তৈরি হচ্ছে ঐ দেশের ক্রেতারাই শুধু ভোগ করছে না। সারা বিশ্বের ক্রেতারা এই পণ্য ব্যবহার করছে। একটি উদাহরণ দিলে সহজ হবে, যেমন- জাপানের তৈরি কম্পিউটার বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। কীভাবে এই কম্পিউটার বাংলাদেশে এসেছে? বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে গুদামজাত ব্যবস্থা ও পরিবহন ব্যবস্থা সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে।

৮। জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন: পণ্য বা সেবা ভোগের মাধ্যমে ক্রেতা অভাব পূরণ করে সন্তুষ্টি অর্জন করে। ক্রেতার প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি না পওয়া গেলে অভাব অপূরণ (Unfulfill) থেকে যাবে। পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাতকরণ লজিস্টিকসের মাধ্যমে ক্রেতার হাতে পৌছিয়ে ক্রেতার অভাব পূরণ করে ক্রেতার জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন করা সম্ভব।

৯। বাজারজাতকরণ উদ্দেশ্য অর্জন: একমাত্র বিক্রয়ের উদ্দেশ্যেই পণ্য তৈরি হয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতির (Free market economics) মূল কথা হলো, পণ্য যেখানেই তৈরি হোক না কেন, দুনিয়ার (The world) আনাচে-কানাচে যেখানে ক্রেতা আছে সেখানেই পণ্য পৌঁছিয়ে দিতে হবে। বাজারজাতকরণ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রধান উপায় হলো সারা বিশ্বে পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা।

একটি সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে, যেমন- বাংলাদেশের উৎপাদিত পোশাক পশ্চিমা বিশ্বে (The western world) বিক্রয় হচ্ছে। একটি দেশের উৎপাদিত পণ্য সারা বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি কীভাবে সম্ভব? একমাত্র উত্তর মার্কেটিং লজিস্টিকস। বাজারজাতকরণ উদ্দেশ্য অর্জনে মার্কেটিং লজিস্টিক প্রত্যক্ষভাবে ১০০% সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।

১০। প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করা: বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই প্রতিযোগিতা আজ সারা বিশ্বের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করে বাজারে টিকে থাকতে হলে কম খরচে, কম সময়ে পণ্যটি ক্রেতার হাতে পৌছিয়ে দিতে হবে। বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। কে কার আগে, কম খরচে পণ্যটি ক্রেতার হাতে পৌছাতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। তুমুল প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় দক্ষ লজিস্টিকস ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়।

১১। ক্রেতা সন্তুষ্টি বৃদ্ধি: ব্যবসায়ের সফলতা নির্ভর করে ক্রেতা সন্তুষ্টির ওপর। ক্রেতা অসন্তুষ্ট হলে ব্যবসা ব্যর্থতায় পর্যবসিত (Falling into failure) হবে। বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করতেই ব্যস্ত নয়, বরং কে কত বেশি পরিমাণ সুবিধা দিয়ে ক্রেতাকে বেশি সন্তুষ্ট (Move ‘satisfaction) রাখতে পারে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখছে। এজন্য তারা অঞ্চলভিত্তিক (Area based) পণ্যের গুদামজাত করছে, নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা সৃষ্টি করছে, বেশি বেশি সেবা কেন্দ্র (Service center) খুলছে। এভাবেই মার্কেটিং লজিস্টিকস আরও বেশি ক্রেতা সন্তুষ্টি (Customer satisfaction) প্রদান করছে।

১২। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ: বিশ্বকে হাতের মুঠোর (Plam on hand) মধ্যে নিয়ে এসেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সারা বিশ্বকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষ ভ্রমণের জন্য চাকরি বা ব্যবসার জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে চলছে। উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের মাধ্যম না থাকলে বিশ্ব অচল হয়ে পড়ত।

১৩। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উপায় হলো উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং এই উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা। পণ্যের বাজার সৃষ্টি না হলে সমস্ত বিনিয়োগ লোকসান হবে। যে দেশ যত বেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে পেরেছে সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি উন্নতি লাভ করেছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। যথা- বাংলাদেশ চীনা পণ্যের (Made in china) একটি বৃহত্তর বাজারে পরিণত হয়েছে। চীন অর্থনৈতিকভাবে একটি উন্নত দেশ।

১৪। প্রচারমূলক কৌশল: অতি অল্প সময়ের (Very short time) মধ্যে কম খরচে পণ্যের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে পণ্যটি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া আধুনিক লজিস্টিকসের প্রধান উদ্দেশ্য। ক্রেতা যখন কম দামে একটি ভালোমানের পণ্য পায় তখন ঐ পণ্যটি ক্রেতা বার বার ক্রয় (Repeated purchase) করবে। এভাবে একটি দক্ষ বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস প্রচারমূলক কৌশল হিসেবে কাজ করে।


আরও দেখুন: বিজনেসের ক্ষেত্রে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রক্রিয়া বর্ণনা কর
আরও দেখুন: পণ্যের মান ও মূল্য তুলনা করার পদ্ধতিগুলো বর্ণনা কর
আরও দেখুন: লজিস্টিক সাপোর্ট কী? এর বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।

আশাকরি “লজিস্টিক সাপোর্ট এর সুবিধাসমূহ কি কি?” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

Leave a Comment