আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি লজিস্টিক সাপোর্ট কী? এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে চাচ্ছেন? আজকের আর্টিকেল টি আপনার জন্য। আজকের আর্টিকেলে লজিস্টিক সাপোর্ট ও এর বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। কথা না বাড়িয়ে তাহলে চলুন শুরু করি।
লজিস্টিক সাপোর্ট কী?
কাঁচামাল বা চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত পণ্য বা সেবা উৎপাদনকারীর কাছ থেকে উপযুক্ত সময়ে, উপযুক্ত স্থানে সঠিক ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে-সব উপকরণের সাহায্যে নেওয়া হয়। যেমন- পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতির যথাযথ পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস সাপোর্ট বলে।
ক্রেতা নির্বাচন, নির্বাচিত ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো এবং নির্ধারিত পণ্য বা সেবার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস সাপোর্ট চার ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। যথা-
(i) পণ্য সরবরাহ: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস-এর একটি কাজ হচ্ছে, পণ্য বা সেবার সম্ভাব্য ক্রেতা খুঁজে বের করা এবং কীভাবে কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার কাছে পণ্য বা সেবা পৌছানো যায় তা নির্ধারণ করা। একেক ক্রেতার চাহিদা একেক রকম হতে পারে। যার প্রেক্ষিতে প্রত্যেক ক্রেতার জন্য বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস কৌশল ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস-এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে ফরমায়েশ সংগ্রহ করা, সময়মতো পণ্য বা সেবা সরবরাহ করা এবং পণ্য বা সেবার ক্ষতি সর্বনিম্ন রাখা।
(ii) মূল্য: প্রতিষ্ঠানের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস দ্বারা মূল্যের পরিবর্তনের কারণসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। সম্ভাব্য ক্রেতার প্রোফাইল, পণ্যের ধরন এবং ফরমায়েশের ধরন ইত্যাদি উপাদানসমূহ পণ্যের মূল্য পরিবর্তনের কারণ (Drive) হিসেবে কাজ করে।
(iii) প্রসার: যখন পণ্য বাজারে উপস্থাপিত হয় তখন প্রতিষ্ঠানকে লজিস্টিকস এবং বাজারজাতকরণের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে হয়। সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়া, ক্রেতাকে বা উৎপাদককে তথ্য সরবরাহ, চাহিদা ও যোগানে সামঞ্জস্যতা রাখা প্রভৃতি লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে প্রতিষ্ঠানের সুনাম সৃষ্টি হয়। আর সুনাম পণ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
(iv) স্থান: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস এমনভাবে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করবে যেন ক্রেতারা লজিস্টিক সম্পর্কিত কোনো জটিলতার সম্মুখীন না হয়। বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস-এর স্থান সম্পর্কিত কাজ হচ্ছে ক্রেতার সাথে লজিস্টিকস দাতার লেনদেন সহজীকরণ করা।
লজিস্টিক সাপোর্ট এর বৈশিষ্ট্য
যে-সব পদ্ধতি, উপায় বা উপকরণের (যেমন- গুদামজাতকরণ, পরিবহন ব্যবস্থা) সাহায্যে উৎপাদিত পণ্য ভোক্তা বা পণ্যের ব্যবহারকারী বা শিল্পের ব্যবহারকারীর কাছে প্রেরণ করা হয় সে উপকরণকে লজিস্টিক সাপোর্ট বলে। নিচে বাজারজাতকরণ লজিস্টিক সাপোর্ট-এর বৈশিষ্ট্য (Characteristics) তুলে ধরা হলো-
১। কাঁচামাল ও গুদামজাতকরণ: চূড়ান্ত পণ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত কাঁচামাল একসাথে (At a time) ব্যবহার করা যায় না। উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য কাঁচামালের গুদামজাত করতে হয়।
২। চূড়ান্ত পণ্যের গুদামজাতকরণ: কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত চূড়ান্ত পণ্য একসাথে ভোক্তাদের কাছে প্রেরণ করা হয় না। ভোক্তাদের ভোগকে সচল রাখার জন্য পণ্য উৎপাদন করে গুদামজাত করে রাখতে হয়। এখান থেকে ভোক্তাদের প্রয়োজনমতো পণ্যের সরবরাহ করা হয়।
৩। গুদামের অবস্থান: গুদামের অবস্থান উৎপাদন স্থানের পাশেই হতে হবে। যাতে করে পণ্য সহজেই কারখানা থেকে গুদামে সংরক্ষণ করা যায়।
৪। গুদামের পরিবেশ: গুদামের পরিবেশ পণ্যের উপযোগী হতে হবে। গুদামের আলো, উত্তাপ, উচ্চতা, পণ্যের উপযোগী হতে হবে। গুদামের ভেতরে স্যাঁতসেঁতে ভাব, খুব বেশি ঠান্ডা, খুব বেশি গরম ইত্যাদি পণ্যের জন্য ক্ষতিকর। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে পণ্যের গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার উপযোগিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এতে, প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
৫। কাঁচামাল পরিবহন: উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের পরিবহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে উৎপাদন স্থানে কাঁচামাল সরবরাহ করা না হলে উৎপাদনে বিঘ্নতার (Hindrance) সৃষ্টি হবে। এর ফল হিসেবে চিরদিনের জন্য ক্রেতাকে হারাতে হবে।
৬। চূড়ান্ত পণ্যের পরিবহন: চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত পণ্য উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে সঠিক ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। পরিবহন ব্যবস্থার কারণেই এক স্থানের উৎপাদিত পণ্য সারা বিশ্বে (Whole world) পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।
৭। খরচ: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকের সাথে খরচের বিষয়টি জড়িত রয়েছে। পণ্যের গুদামজাতকরণ ও পরিবহন খরচ যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ রাখতেই হবে। এই তুমুল প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকতে হলে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।
৮। দক্ষ ব্যববস্থাপনা: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস (Marketing logistics) দক্ষতার সাথে ব্যবহার করার জন্য পরিকল্পনা, বাস্ত বায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দক্ষ লজিস্টিক ব্যবস্থাপক নিয়োগ করে এই কাজের দায়িত্ব দিতে হবে।
৯। সময় উপযোগী লজিস্টিকস: সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন লজিস্টিক আবিষ্কার হয়েছে। প্রতিষ্ঠান যদি উন্নত, আধুনিক লজিস্টিক আবিষ্কার ও ব্যবহার না করে তাহলে দক্ষ ক্রেতাকে সেবা প্রদান করতে পারবে না। দক্ষ ক্রেতাকে সেবা না দিলে প্রতিষ্ঠান টিকে (Sustain) থাকতে পারবে না।
১০। বহির্মুখী লজিস্টিকস: যে প্রক্রিয়ায় কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য পুনঃবিক্রেতার মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, তাকে বহির্মুখী লজিস্টিক বলে। অর্থাৎ, উৎপাদিত পণ্য কারখানা থেকে পরিবহন করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোকে বহির্মুখী লজিস্টিক বলে।
১১। অন্তর্মুখী লজিস্টিকস: যে প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল সরবরাহকারীর কাছ থেকে উৎপাদনের জন্য কারখানায় আনা হয়, তাকে অন্তর্মুখী লজিস্টিকস বলে। অর্থাৎ, বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে পরিবহনের মাধ্যমে কারখানায় স্থানান্তর করা হলো অন্তর্মুখী লজিস্টিকস (Inbound logistics) ।
১২। বিপরীতমুখী লজিস্টিকস: ভোক্তাদের ব্যবহৃত পণ্যের উচ্ছিষ্ট (Wastage) অংশ দিয়ে নতুন পণ্য সৃষ্টির জন্য কারখানায় প্রেরণ করাকে বিপরীতমুখী (Reverse) লজিস্টিকস বলে। অর্থাৎ, বিপরীতমুখী লজিস্টিকস-এর মাধ্যমে ভোক্তা বা খুচরা বিক্রেতা বা পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে উচ্ছিষ্ট বা উদ্বৃত্ত পণ্য বা অপ্রত্যাশিত পণ্য কারখানায় প্রেরণ করে সেগুলো আবার নতুন পণ্য সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়। যেগুলো কোনো কাজেই লাগে না সেগুলো নিরাপদ বর্জ্য হিসেবে অপসারণ করা হয়।
১৩। সমন্বয়সাধন: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকস কাঁচামালের সরবরাহকারক, ক্রয় প্রতিনিধি (Agent) এবং ক্রেতাদের মধ্যে সমন্বয়সাধনের কাজ করে। অর্থাৎ সহজভাবে বলা যায়, মার্কেটিং লজিস্টিকস সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে।
১৪। ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমের প্রয়োগ: উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা ও সফলতার সাথে মার্কেটিং লজিস্টিকসের কাজ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন কোম্পানিগুলো আধুনিক সাপ্লাই চেইন সফটওয়্যার (Software), ইন্টারনেটনির্ভর লজিস্টিকস পদ্ধতি, বিক্রয়কেন্দ্রে স্ক্যানার (Point of sale scanner), স্যাটেলাইটের প্রয়োগ, পণ্যের অর্ডার প্রেরণ ও লেনদেন সকল কিছুই ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। এক কথায় পণ্যের বণ্টন পদ্ধতিতে এসেছে দক্ষ ও উপযুক্ত ক্রেতা সেবা দেওয়ার নিশ্চয়তা।
১৫। পরিবেশবান্ধব মার্কেটিং লজিস্টিকস: বাজারজাতকরণ লজিস্টিকসের কাজ পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। পরিবহন, গুদামজাতকরণ, প্যাকেজিং এবং অন্যান্য লজিস্টিকস কাজগুলো পরিবেশের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এসব কাজের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড কালো ধোঁয়া প্রভৃতির সৃষ্টি হয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে।
কিন্তু মার্কেটিং লজিস্টিকস ম্যানেজারকে মনে রাখতে হবে যে, পরিবেশ সুরক্ষা না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই (Sustainable) হবে না। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক মার্কেটিং লজিস্টিকস ম্যানেজার পণ্যের গুদামজাত, পরিবহন ও প্যাকেজিং-এর মতো কাজগুলো উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটভিত্তিক লজিস্টিকস পদ্ধতি ইলেকট্রনিক্স-এর মাধ্যমে পণ্যের অর্ডার ও লেনদেন সম্পাদন করছে।
প্রত্যক্ষভাবে আমরা এর সুবিধা ভোগ করছি। যেমন- পরিবহনগুলো উন্নত ও আধুনিক হওয়ার কারণে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি পণ্য বহন করতে সক্ষম হয়েছে। পরিবহনের গতি বেড়েছে, মুহূর্তের মধ্যেই যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে যোগাযোগ সংখ্যা কমেছে, ডিজেলের ব্যবহার কম হচ্ছে, শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে এবং ক্ষতিকর ব্যাগ কম ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ, এখনকার মার্কেটিং লজিস্টিকস হলো পরিবেশবান্ধব (Environment friendly)।
১৬। ক্রেতাকেন্দ্রিক লজিস্টিকস: বাজারজাতকরণের পূর্ব ধারণা ছিল, কত কম খরচে (Lowest) ক্রেতার কাছে পণ্যটি পৌঁছানো যায়। আর এখন চিন্তা করা হয়, কম খরচে এবং সবচেয়ে কম সময়ে পণ্যের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে কীভাবে ক্রেতার কাছে পণ্যটি পৌছানো যায়।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, ক্রেতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে পণ্যের গুদামজাতকরণ সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে, সঠিক ক্রেতার কাছে পণ্যটি উপস্থাপনের জন্য লজিস্টিকের বৈশিষ্ট্য বুঝে বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
আরও দেখুন: লজিস্টিক সাপোর্ট-এর সীমাবদ্ধতাগুলো উল্লেখ কর।
আরও দেখুন: পণ্যের মান ও মূল্য তুলনা করার পদ্ধতিগুলো বর্ণনা কর
আশাকরি “লজিস্টিক সাপোর্ট কী? এর বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।