শিল্পের প্রকারভেদ আলোচনা কর: সম্পদ সংগ্রহ, উৎপাদন, বণ্টন ও এদের সহায়ক কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলা হয়। ব্যবসায়কে একটি সামাজিক প্রক্রিয়াও বলা হয়। ব্যবসায় ছাড়া কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যবসায়ের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা রয়েছে। শিল্প হচ্ছে এসব শাখা প্রশাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শাখা যাতে উৎপাদন কাজ পরিচালিত হয়।
শিল্পের সংজ্ঞা
সাধারণত দ্রব্য ও সেবার উৎপাদনকে শিল্প বলে। প্রকৃতপক্ষে, শিল্প বলতে উৎপাদনের প্রক্রিয়াসমূহকেই বুঝিয়ে থাকে। আবার উৎপাদন বলতে কোনোকিছু তৈরি বা প্রস্তুত করাকেও বোঝায়। কিন্তু মানুষ দ্রব্য প্রস্তুত বা উৎপাদন করতে পারে না। দ্রব্যসমূহ প্রকৃতির দান । মানুষ কেবল এর আকৃতি, রং, রূপ ও মালিকানা বদলিয়ে এগুলোর নতুন নতুন উপযোগ সৃষ্টি করে মাত্র। সুতরাং কোনো দ্রব্যের উৎপাদন, নিষ্কাশন, উত্তোলন, শোধন ও প্রস্তুতকরণ সংক্রান্ত সকল কাজকেই শিল্প বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
১. অধ্যাপক এম. সি. শুক্লা বলেন, “পণ্যদ্রব্যের উত্তোলন, উৎপাদন, রূপান্তর, প্রক্রিয়াকরণ কিংবা সংযোজন প্রক্রিয়াকে শিল্প বলে।”
২. পি.এইচ. কলিন-এর মতে বলেন, “শিল্প বলতে পণ্য প্রস্তুতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কারখানা বা কোম্পানি বা প্রক্রিয়াকে বোঝায়।”
৩. অধ্যাপক গুহ ও মুখার্জীর মতে, “শিল্প বলতে মানুষের ঐ কর্মপ্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার সাহায্যে মানুষ প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ আহরণ ও তার রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে।”
৪. ড. এম. এ. মান্নান বলেন, “প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে এর রূপান্তরের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি করার প্রয়াসকে শিল্প বলে।”
৫. অধ্যাপক এল. কবীর বলেন, “পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্মের উৎপাদন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলিকে শিল্প বলে।”
সুতরাং উৎপাদনের যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টা যার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করে এর রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষের ভোগ ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার নিমিত্ত আরও অধিকতর উপযোগ সৃষ্টি করা হয়, তাকে শিল্প বলা হয়।
শিল্পের প্রকারভেদ আলোচনা কর
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পকে বিভক্ত করা যায়। তবে এখানে আমরা শিল্পের মৌলিক শ্রেণিবিভাগ বা প্রক্রিয়াগত যে শ্রেণিবিভাগ রয়েছে তা আলোচনা করব। শিল্পের উপর্যুক্ত প্রকারভেদ নিচে আলোচনা করা হলো-
ক. প্ৰাথমিক শিল্প: প্রকৃতিপ্রদত্ত সকল দ্রব্যসামগ্রী; যেমন- ধান, পাট, নারকেল, সুপারি, মাছ, পশুপাখি, ভূগর্ভস্থ যাবতীয় খনিজ, সম্পদ ইত্যাদি প্রাথমিক শিল্প। জলবায়ু ও মৃত্তিকা হতে প্রত্যক্ষভাবে প্রাপ্ত যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রীও প্রাথমিক শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক শিল্পকে আবার নিম্নোক্ত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১. কৃষি শিল্প: বিভিন্ন প্রকার কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষিকাজের সাথে শিল্প সংশ্লিষ্ট তাকে কৃষি শিল্প বলা হয় । এ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যাদির মধ্যে ধান, গম, পাট, তুলা, আখ, ভুট্টা, যব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২. প্রজনন শিল্প: যে শিল্পে প্রজনন প্রক্রিয়ায় সম্পদ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হয় তাকে প্রজনন শিল্প বলা হয়। পশুপাখি, মৎস্য, ফলমূল ইত্যাদি প্রজনন শিল্পের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা হয়।
৩. নিষ্কাশন শিল্প: যে প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদাদি আহরণ বা উত্তোলন করা হয় তাকে নিষ্কাশন শিল্প বলে। যেমন— বন থেকে কাঠ সংগ্রহ, খনি থেকে তেল, গ্যাস, সোনা, লোহা ইত্যাদি উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিষ্কাশন শিল্পের আওতাভুক্ত।
খ. দ্বিতীয় স্তরের শিল্প: যেসব শিল্পদ্রব্য প্রাথমিক শিল্প হতে সংগৃহীত এবং যেগুলোকে ভোগকারীদের জন্য অধিকতর উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়াজাত করা হয় সেগুলো দ্বিতীয় স্তরের শিল্পের মধ্যে পড়ে। এগুলোকে আবার প্রক্রিয়ানুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে; যথা-
১. উৎপাদন শিল্প: যে শিল্প কৃষিজাত দ্রব্যগুলোকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রং, রূপ ইত্যাদি পরিবর্তন করে ভোগের উপযুক্ত করে তোলে তাকে উৎপাদন শিল্প বলে; যথা— পাট শিল্প, তুলা শিল্প ইত্যাদি।
২. নির্মাণ শিল্প: নির্মাণ শিল্প দ্বারা সেসব শিল্পকে বুঝিয়ে থাকে যেগুলো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, রেলপথ ইত্যাদি প্রস্তুত করে থাকে।
৩. সেবা পরিবেশন শিল্প: দেশের যেসব জনহিতকর প্রতিষ্ঠান উক্ত দেশের জনগণকে সেবার উপকরণাদি সরবরাহের উদ্দেশ্যে ওঠে সেগুলোকে সেবা পরিবেশন শিল্প বলে। যেমন- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল প্রভৃতি উৎপাদন ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত শিল্পসমূহ সেবা পরিবেশন শিল্প।
ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ভিত্তিতে শিল্পের প্রকারভেদ
ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দিক হতে শিল্পকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়; যথা-
১. রাষ্ট্রচালিত শিল্প: যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয় সেগুলোকে রাষ্ট্রচালিত শিল্প বলে। সাধারণত বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পগুলো রাষ্ট্র দ্বারা চালিত হয়; যথা— পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কাগজ শিল্প, চিটাগাং আয়রন এন্ড স্টিল মিলস্, টঙ্গী টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রিজ ইত্যাদি।
২. বৃহদায়তন শিল্প: বড় বড় শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বৃহৎ উৎপাদন । এগুলোতে ঝুঁকি বেশি এবং পুঁজিও খাটাতে হয় প্রচুর। সেজন্য এগুলো রাষ্ট্রীয় বা যৌথমূলধনী ব্যবসায় দ্বারা পরিচালিত হয়।
৩. কুটির শিল্প: মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, খেলনা তৈরি শিল্প, মেটাল তৈরি শিল্প ইত্যাদি।
উপসংহার: কোনো শিল্পসামগ্রী যা আমরা ভোগ করছি তা বিভিন্ন ধরনের জটিল উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের হাতে এসে পৌঁছে। সব দিক বিচার-বিবেচনা করে তাই শিল্পকে উপর্যুক্ত ভাগে শ্রেণিবিভক্ত করা যায়। মানুষের পরিবর্তিত ভোগ চাহিদার কারণে শিল্পের উল্লিখিত শ্রেণিবিভাগের সাথে ভবিষ্যতে আরও নতুন ধরনের প্রক্রিয়াগত শিল্প যুক্ত হতে পারে।
✔ আরও দেখুন: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর
✔ আরও দেখুন: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান
✔ আরও দেখুন: ব্যবসায়ের কার্যাবলি আলোচনা কর
✔ আরও দেখুন: ব্যবসায়ের আওতা ও পরিধি বর্ণনা কর
✔ আরও দেখুন: ব্যবসায়ের আওতা ও পরিধি বর্ণনা কর
আশাকরি “শিল্পের প্রকারভেদ আলোচনা কর” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।