সামাজিক প্রতিষ্ঠান – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৫ম অধ্যায়

সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৫ম অধ্যায়: সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহ, পরিবার ও জ্ঞাতিসম্পর্ক সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পারিবারিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বিবাহ হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমেই পরিবারের সৃষ্টি হয়। আর জ্ঞাতিসম্পর্ক হলো পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক বন্ধনের নির্দেশক। বর্তমান অধ্যায়ে বিবাহ, পরিবার ও জ্ঞাতিসম্পর্কের উৎপত্তি, বিবর্তন, প্রকারভেদ, গুরুত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।


সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৫ম অধ্যায়

প্রশ্ন-১. সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সমাজে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলেই সমাজের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য টিকে আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিভিন্ন অভাব ও প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করে। অর্থাৎ- বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান মানুষের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকে।

প্রশ্ন-২. “সমবিবাহ ও অসমবিবাহের মধ্যে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান”— ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সমবিবাহ ও অসমবিবাহের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। পাত্রপাত্রীর মধ্যে যখন বয়স, শিক্ষা, রুচি, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক বংশীয় মর্যাদা সমান হয়, তখন তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিবাহকে সমবিবাহ বলা হয়। মনোবিজ্ঞানীগণের মতে, সমবিবাহে আবদ্ধ নবদম্পতির পক্ষে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং খাপ খাওয়ানো সহজতর হয়।

পক্ষান্তরে, পাত্রপাত্রীর মধ্যে যখন উপরিউক্ত বিষয়সমূহের সমতা পরিলক্ষিত না হয়, তখন সে ধরনের বিবাহকে অসমবিবাহ বলা হয়। সাধারণত, অসমবিবাহে আবদ্ধ নব দম্পতির পারস্পরিক সম্পর্কে গড়মিলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ থেকে এটা বোঝা যায় যে, এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

প্রশ্ন-৩. বিবাহ বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: বিবাহ হলো একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী গ্রোভস (Ernest Groves) বলেন, “বিবাহ হচ্ছে এমন একটি দুঃসাহসিক বন্ধুত্ব যার আইনত নিবন্ধন এবং সামাজিক গোষ্ঠীর সমর্থন আছে।” কার্যত বিবাহ হলো এমন একটি আনুষ্ঠানিকতা, যার মাধ্যমে সমাজ নারী- পুরুষের যৌন সম্পর্ক এবং তাদের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। বিবাহের মাধ্যমেই পরিবারের সৃষ্টি হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে।

প্রশ্ন-৪. বিবাহ কীভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে?

উত্তর: সমাজ স্বীকৃত উপায়ে যৌন প্রবৃত্তি পরিচালনার মাধ্যমে বিবাহ সামাজিক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানব সমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক স্বার্থে ব্যক্তির যৌন সম্পর্ক এবং আচরণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। সুস্থ সমাজজীবনের জন্য নারী-পুরুষের যৌন আচরণ অবাধ ও উচ্ছৃঙ্খলভাবে চলতে দেয়া যায় না।

কারণ তা না হলে পরিবার ও সমাজজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। বিবাহ এ যৌন প্রবৃত্তিকে সমাজ স্বীকৃত উপায়ে মেটানোর ব্যবস্থা করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। যা সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এভাবেই সামাজিক নিয়ন্ত্রণে বিবাহ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

প্রশ্ন-৫. লেডিরেট ও সরোরেট বিবাহ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: লেভিরেট ও সরোরেট হচ্ছে পাত্র-পাত্রীর পরিচিতির ভিত্তিতে বিবাহের দুটি প্রকারভেদ। লেভিরেট বিবাহ রীতিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী মৃত স্বামীর যেকোনো ভাইকে বিবাহ করে। সাধারণত ওই বিধবার কোনো সন্তান থাকলে অথবা পরিবারের মধ্যে সম্পত্তির রেখে দেওয়ার জন্য এ ধরনের বিবাহ সংঘটিত হয়।

আর সরোরেট বিবাহ প্রথায় কোনো ব্যক্তি তার মৃত স্ত্রীর বোনকে বিবাহ করে। আমাদের সমাজে এর উদাহরণ পাওয়া যায়। সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ককে স্থায়ী করতে অথবা অল্প বয়সী শিশু সন্তানের লালন-পালনের সুবিধার্থে অনেকে এই পথ বেছে নেন।

প্রশ্ন-৬. অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ কী? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ মূলত বহির্বিবাহের অন্তর্গত। উঁচু বর্ণের পাত্রের সাথে নিম্নবর্ণের পাত্রীর বিবাহকে বলা হয় অনুলোম (Hypergamy) বিবাহ। অন্যদিকে, নীচু বর্ণের পাত্রের সাথে উচু বর্ণের পাত্রীর বিবাহকে বলা হয় প্রতিলোম (Hypogamy) বিবাহ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি ব্রাহ্মণবংশীয় পাত্রের সাথে বৈশ্যবর্ণের পাত্রীর বিবাহ হয় তাহলে তা অনুলোম বিবাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অন্যদিকে শূদ্রবংশীয় পাত্রের সাথে ব্রাহ্মণবংশীয় পাত্রীর বিবাহ হলে তা হবে প্রতিলোম বিবাহ।

প্রশ্ন-৭. ‘পরিবার একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান’— ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: পরিবার একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান, কেননা বিশ্বের সর্বত্র মানবসমাজ বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (Robert Morrison Maclver)-এর মতে, “মানব সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে পরিবারের অস্তিত্ব ছিল।” বস্তুত দেশ-কাল নির্বিশেষে পরিবার একটি স্থায়ী ও শাশ্বত সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

মানুষমাত্রই কোনো না কোনোভাবে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বা পারিবারিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত। এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। কেবল মানব সমাজেই নয়, পারিবারিক জীবনের অস্তিত্ব অন্যান্য প্রাণির মধ্যেও দেখা যায়। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের কাঠামো ও কার্যাবলিতে পরিবর্তন এলেও তা এত দীর্ঘ সময়েও বিলুপ্ত হয়নি। এ কারণেই পরিবারকে সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়।

প্রশ্ন-৮. ‘পরিবার একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সংগঠন’— বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর: পরিবারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গুরুত্ব পর্যালোচনা করে পরিবারকে মৌলিক অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরিবারের ভরণপোষণ করার জন্য আয় ও উৎপাদন করতে হয় এবং তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

আদিম সমাজে স্ত্রী এবং সন্তানসন্ততিদের সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হতো। কারণ স্ত্রী ও সন্তানই ছিল অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবারগুলো এখনো পর্যন্ত উৎপাদন, আয় ও ভোগের একক। সেখানে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কৃষিকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে। এজন্যই পরিবারকে মৌলিক অর্থনৈতিক সংগঠন বলা হয়।

প্রশ্ন-৯. পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে ওয়েস্টারমার্কের মতবাদ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: ফিনল্যান্ডের দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক তার “The History of Human Marriage (১৮৯১) গ্রন্থে বলেন, একক বিবাহভিত্তিক পরিবারই হচ্ছে সর্বজনীন পরিবার। তার মতে, সর্বকালে এবং সর্বত্র মানুষ একক বিবাহভিত্তিক পরিবারেই বসবাস করে আসছে। তিনি আরও বলেন, একক বিবাহভিত্তিক পরিবার সব সময়েই ছিল, আছে এবং থাকবে । পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে ওয়েস্টারমার্কের তত্ত্ব মর্গানের পরিবারের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

প্রশ্ন-১০. “শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ পরিবারের অন্যতম কাজ’— – বুঝিয়ে দাও।

উত্তর: শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা পরিবারের প্রধান বা মুখ্য কাজ। শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিশু অবস্থায় সবাই খুব অসহায় থাকে। ফলে তার অসুখসহ নানারকম বিপদ-আপদ ও দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ফলে শিশু আঘাত পাওয়া এমনকী মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কোনো কারণে শিশু বেশি ভয় পেলে বা দীর্ঘ সময় উদ্বেগের শিকার হলে মানসিক ভারসাম্যও হারাতে পারে। সুতরাং প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে শিশুকে সুষ্ঠুভাবে লালনপালন করা তথা সম্ভাব্য বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা পরিবারের প্রধান কাজ।

প্রশ্ন-১১. পরিবারকে শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হয় কেন?

উত্তর: সমাজের কাঙ্ক্ষিত সদস্য হিসেবে গড়ে উঠার জন্য মৌলিক শিক্ষা শিশু প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকে লাভ করে বলে পরিবারকে শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হয়। পরিবারেই শিশুর প্রাথমিক জীবনের ভিত গড়ে ওঠে এবং পরিবারই শিশুর অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র। জন্মের পর শিশু গৃহেই প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে। মাতাই শিশুর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা। আচার-আচরণ, নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিধিবিধান, চাল-চলন, কথা-বার্তা ও ব্যবহারিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শিশু পরিবার থেকেই গ্রহণ করে। যার কারণে পরিবারকে শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হয়।

প্রশ্ন-১২. মর্গান প্রদত্ত পরিবারের উৎপত্তি বা বিবর্তন সংক্রান্ত মতবাদটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: আমেরিকার নৃবিজ্ঞানের জনক লুইস হেনরি মর্গান সুইস আইনজ্ঞ ও নৃবিজ্ঞানী বেকোফেনকে সমর্থন করে বলেন, আদিতে সমাজ জীবনে অবাধ যৌনাচার বিদ্যমান ছিল। তখন যৌন জীবনের ওপর কোনো সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহেরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এরপর অবাধ যৌন জীবনের স্তর অতিক্রম করে মানবসমাজের প্রথম ধরনের পরিবার হিসেবে কনস্যাংগুইন বা রক্ত সম্পর্কযুক্ত পরিবারের সূত্রপাত হয়।

তারপর আপন বা জ্ঞাতিসম্পর্কের কয়েকজন বোনের সঙ্গে একদল পুরুষের বা আপন জ্ঞাতিসম্পর্কের কয়েকজন ভাইয়ের সঙ্গে একদল মহিলার যৌথ বিবাহের ভিত্তিতে পুনালুয়ান পরিবার গঠিত হয়। পরবর্তীতে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার মধ্যে অস্থায়ী যুগল বন্ধনে গঠিত হতো সিনডিয়াসমিয়ান পরিবার। এরপর একজন পুরুষের সঙ্গে একাধিক স্ত্রীর বিয়ের ভিত্তিতে গঠিত হয় পিতৃতান্ত্রিক পরিবার । এরপরে আসে একক বিবাহ পরিবার। এভাবেই মর্গান পরিবারের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রশ্ন-১৩. প্রথাগত জ্ঞাতি কী? বুঝিয়ে বল।

উত্তর: স্থানীয় প্রথাগত সূত্রে কাউকে আত্মীয় করে নেবার যে বন্ধন তাই প্রথাগত জ্ঞাতিসম্পর্ক। আমাদের সমাজে নানা ধরনের জ্ঞাতিসম্পর্ক লক্ষ করা যায়। এসব জ্ঞাতিদের মধ্যে রয়েছে জৈবিক বা রক্ত সম্পর্কীয় জ্ঞাতিসম্পর্ক, বৈবাহিক জ্ঞাতিসম্পর্ক,সগোত্ৰসূচক জ্ঞাতিসম্পর্ক, কাল্পনিক জ্ঞাতিসম্পর্ক ইত্যাদি। প্রথাগত জ্ঞাতি এগুলোর অন্যতম। সাধারণত সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করে এ ধরনের জ্ঞাতিসম্পর্কের সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একই পাড়ায় বসবাসকারী বাবা-চাচার বয়সী ব্যক্তিকে চাচা ডাকা হয়।


আশাকরি “সমাজজীবনে প্রভাববিস্তারকারী উপাদান – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৫ম অধ্যায়” আর্টিকেল টি তোমাদের ভালো লেগেছে। সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র সকল অধ্যায় এর প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Comment