সামাজিক পরিবর্তন – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ১১ অধ্যায়

সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ১১ অধ্যায়: সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় সামাজিক পরিবর্তন। মানব সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। বলা হয়, সমাজবিজ্ঞানীদের মূল কাজ হলো সমাজ পরিবর্তনের সূত্র নির্ণয় করা। সামাজিক পরিবর্তনে এর বিভিন্ন উপাদানসমূহ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

বিবর্তন, প্রগতি, উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমান অধ্যায়ে সামাজিক পরিবর্তনের ধারণা, কারণ, তত্ত্ব, উপাদান এবং বিবর্তন, পরিবর্তন ও উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।


সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ১১ অধ্যায়

প্রশ্ন-১. সামাজিক পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সামাজিক পরিবর্তন বলতে সমাজকাঠামোর পরিবর্তনকে বোঝায়। সমাজকাঠামোর ভিত্তি হলো পারস্পরিক সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়া, তাই সামাজিক পরিবর্তনের অর্থ হলো সংঘবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান যেমন— অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদির পরিবর্তন।

প্রশ্ন-২. শিল্পায়ন সামাজিক পরিবর্তনে যে ভূমিকা পালন করে তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: যেকোনো শিল্পায়িত দেশ এবং শিল্পায়নে নবাগত দেশের দিকে তাকালে সমাজ পরিবর্তনে শিল্পায়নের অবদানের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয় পারিবারিক, সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।

এর ফলে মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি রুচিতেও পরিবর্তন আসে। শিল্পায়নের প্রভাবে ভূমির নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। ভূমি শ্রম পরিত্যাগ করে মানুষ শিল্পশ্রমের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে শিখে। তাই বলা যায়, শিল্পায়নের ফলে সমাজজীবনে গভীর পরিবর্তন সূচিত হয়।

প্রশ্ন-৩. সামাজিক পরিবর্তনে নগরায়ণের ভূমিকা কীরূপ? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: নগরায়ণের ফলে মানুষ কৃষিজ পেশা বাদ দিয়ে নানা ধরনের পেশা গ্রহণ করে বিধায় সমাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। শহুরে পেশায় বৈচিত্র্য থাকায় গ্রামের মানুষ দলে দলে শহরমুখী হয়, দলে দলে মানুষ শহরে পাড়ি জমানোর ফলে যৌথ পরিবারে ভাঙন শুরু হয় এবং একক পরিবারের সৃষ্টি হয়। নগরায়ণের ফলে অনেক মিথ্যা কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে মানুষ বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়। এভাবে নগরায়ণ সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।

প্রশ্ন-৪. “সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে”- ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: শিক্ষা মানুষের প্রকৃতি ও আচরণে পরিবর্তন আনে। শিক্ষা মানুষের মধ্যে সুন্দর গুণগুলোকে ফুটিয়ে তোলে। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের মানুষের মাঝে সামাজিক আদর্শ; ভাবধারা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ শিক্ষা মানুষের চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটায়। এতে ধ্যান-ধারণার শ্রীবৃদ্ধি হয়। মানুষ অন্ধ কুসংস্কার ও যুক্তিহীন জীবনাচরণ থেকে বিরত থাকে। শিক্ষা মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলে।

মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায় । অর্থাৎ সমাজে এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। তাছাড়া আধুনিককালে বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থার ফলে জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ সমাজ পরিবর্তনে বিপুল সফলতা লাভ করেছে। অতএব বলা যায়, সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন-৫. সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী গিন্সবার্গ যে সব কারণকে দায়ী করেছেন তা উল্লেখ করো।

উত্তর: ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী মরিস গিন্সবার্গ সামাজিক পরিবর্তনের আটটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো: ১. ব্যক্তিসমূহের সচেতন আকাঙ্ক্ষা ও সিদ্ধান্ত; ২. পরিবর্তিত পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত ঘটনা; ৩. কাঠামোগত পরিবর্তন এবং টানাপড়েন; ৪. বহিরাগত প্রভাব; ৫. বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অথবা তাদের নিয়ে গঠিত গোষ্ঠী; ৬. নানা উৎস থেকে আহরিত উপাদানের একত্রে এক বিন্দুতে সম্মিলন অথবা পাশাপাশি সংস্থাপন; ৭. আকস্মিক ঘটনাবলি; ৮. একটি সর্বজনীন লক্ষ্যের উদ্ভব।

প্রশ্ন-৬. সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম, যেমন— পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণ ও সরকারের মধ্যে যোগাযোগ ও জনগণের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়, যা গণসচেতনতা সৃষ্টি করে। এতে জনসাধারণের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে যা সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

প্রশ্ন-৭. অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন কীভাবে সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে?

উত্তর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সমাজের উৎপাদনের উপকরণসমূহের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক কাঠামো। এ উপকরণসমূহের কোনো একটির পরিবর্তনের কারণে গোটা অর্থব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে। আর এটা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অর্থব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণে মানুষের আচার-আচারণ, চাল-চলন ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, যা মূলত সামাজিক পরিবর্তন।

প্রশ্ন-৮. সামাজিক পরিবর্তনের প্রাকৃতিক কারণটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সামাজিক পরিবর্তনে প্রাকৃতিক কারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতির এ পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে সাধারণত গোটা মানবগোষ্ঠীর ওপর। এর ফলে মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় আবহাওয়া, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে সাথে সাথে সে এলাকার জনগণের সার্বিক জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে থাকে এবং এর প্রভাবে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

প্রশ্ন-৯. আদর্শবাদী নিয়ন্ত্রণবাদ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: আদর্শ দ্বারা সমাজ পরিবর্তিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানে যে মতবাদ অনুসৃত হয় তা আদর্শবাদী নিয়ন্ত্রণবাদ হিসেবে পরিচিত। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার এ মতবাদকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মতে, ধর্মীয় আদর্শ বা মূল্যবোধ সমাজ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। অর্থাৎ ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ সমাজের অর্থব্যবস্থাসহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে এবং এগুলোর পরিবর্তন সূচিত করে। এ মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে আদর্শবাদী লীবোঁ, ফ্রেজার, টার্ডে ও এলউড অন্যতম।

প্রশ্ন-১০. স্পেংলারের সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কিত আবর্তনবাদ মতবাদটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: জার্মান ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক স্পেংলার তাঁর ‘The Decline of the Wesi’ গ্রন্থে আবর্তনবাদ মতবাদের অবতারণা করেন। স্পেংলারের মতে, পৃথিবীর প্রত্যেক সংস্কৃতি পর্যায়ক্রমে চারটি স্তরের ভিতর দিয়ে নিয়মিতভাবে আবর্তিত হয়। সংস্কৃতির আবর্তনের এ স্তরগুলোকে তিনি প্রকৃতির ঋতুচক্রের মতো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শীত প্রভৃতি নামকরণ করেছেন। তিনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর উত্থান ও পতন চক্রাকার মতবাদের নিরিখেই চিন্তা করেছেন।

গ্রিক, রোমান, মিসরীয় প্রভৃতি সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও ধ্বংস বিশ্লেষণ করে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সব সভ্যতা কতগুলো স্তর অতিক্রম করে চলে। আর সেগুলো হচ্ছে উন্মেষ, পূর্ণতা ও ধ্বংস। পৃথিবীর সব সভ্যতাই আবর্তনশীল বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন-১১. সামাজিক বিবর্তন বলতে কী বুঝ?

উত্তর: সামাজিক বিবর্তন বলতে সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনকে বোঝায়। সামাজিক বিবর্তন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ, সামাজিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান সরল অবস্থা থেকে ধীর পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। সুতরাং সামাজিক বিবর্তন হচ্ছে সমাজ কাঠামোর সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায় রূপান্তর।

প্রশ্ন-১২. বিবর্তন ও প্রগতির পার্থক্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: বিবর্তন হচ্ছে ধীরগতিতে ক্লম পরিবর্তন। আর প্রগতি হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত বা বাঞ্ছিত পরিবর্তন। বিবর্তন প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে। এখানে পরিকল্পনার কোনো স্থান নেই। এটি প্রাণিজগত, উদ্ভিদজগত অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকৃতিতে সতত ক্রিয়াশীল।

অন্যদিকে প্রগতি সর্বদাই সামনে চলা এবং এগিয়ে চলার রীতিই অনুসরণ করে। এর দৃষ্টি সামনে, পেছনে তাকানো বা বর্তমানে আটকে থাকা এর লক্ষ্য নয়। বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে সমাজ কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত ধারায় সামনে এগিয়ে চলাই প্রগতির ধর্ম।

প্রশ্ন-১৩. বিবর্তন কী? বুঝিয়ে বল।

উত্তর: বিবর্তন বলতে ধীরগতিতে ক্রমপরিবর্তনকে বোঝায়। বিবর্তন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজগুলো অধিকতর জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। আর এই জটিল রূপ পরিগ্রহ করার কারণ হলো অধিকতর উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা পরিবেশকে কাজে লাগানো। তাই বলা যায়, বিবর্তন বলতে সবসময় অগ্রসরতাকে বোঝানো হয়। যেমন— কৃষি ক্ষেত্রে সনাতনী ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে কৃষির বিবর্তন।

প্রশ্ন-১৪. সামাজিক উন্নয়ন বলতে কী বোঝ?

উত্তর: সামাজিক উন্নয়ন বলতে কোনো সমাজের অপেক্ষাকৃত উন্নততর অবস্থাকে নির্দেশ করে। সামাজিক উন্নয়নের সাথে মূল্যবোধের ব্যাপারটিও জড়িত। সমাজের সকল ক্ষেত্রের ইতিবাচক পরিবর্তনই সামাজিক উন্নয়ন। পূর্বের অবস্থা থেকে অধিকতর উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়াই সামাজিক উন্নয়ন। অতএব, সামাজিক উন্নয়ন এমন একটি প্রত্যয় যা উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের ধারাকে নির্দেশ করতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন-১৫. ‘প্রগতি’ বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: কোনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের অভিমুখে অগ্রসর হওয়াকে প্রগতি বলে। প্রগতির ইংরেজি প্রতিশব্দ চৎড়মৎবংং; যার অর্থ হচ্ছে সামনে চলা। অর্থাৎ মানুষের জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার এবং পরিকল্পনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিশেষ অবস্থা থেকে আরেকটি বিশেষ অব সামাজিক উত্তরণকে প্রগতি বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধনতান্ত্রিক – সমাজ ব্যবস্থাকে যদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন করা যায় তবে সেটি প্রগতির রূপ লাভ করবে।


আশাকরি “সামাজিক পরিবর্তন – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ১১ অধ্যায়” আর্টিকেল টি তোমাদের ভালো লেগেছে। সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র সকল অধ্যায় এর প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Comment