সমাজবিজ্ঞানের মৌল প্রত্যয় – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৪র্থ অধ্যায় সমাধান

সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৪র্থ অধ্যায় সমাধান: বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাতেই এমন কিছু মৌলিক প্রত্যয় থাকে যা ওই বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তেমনি সমাজবিজ্ঞানেও নানারকম পদ বা প্রত্যয় বিদ্যমান। এ অধ্যায়ে সমাজবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় যেমন- সমাজ, সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দল, সংঘ, প্রতিষ্ঠান, প্রথা, লোকাচার, লোকরীতি, সমাজকাঠামো, সামাজিক স্তরবিন্যাস, সামাজিক গতিশীলতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।


সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৪র্থ অধ্যায় সমাধান

প্রশ্ন-১. সমাজ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সমাজ হচ্ছে এমন এক জনগোষ্ঠী যারা একটি সাধারণ ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবন প্রণালিতে অভ্যস্ত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে বাস করে। মুম্বাই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞানী পাসকুয়াল গিসবার্ট সমাজের সংজ্ঞা প্রদানে বলেন, “সমাজ হলো সামাজিক সম্পর্কের এক জটিল জাল, যার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষ তার সঙ্গীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত।” সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে- সংঘবদ্ধতা, নিয়ন্ত্রিত সামাজিক জীবন, স্থায়িত্ব, নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধের অস্তিত্ব, সাধারণ উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

প্রশ্ন-২. আদিম সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা কীরূপ ছিল? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: আদিম সমাজের লোকদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল ও নিম্নমানের। তারা দলবদ্ধ হয়ে বনজঙ্গল হতে ফলমূল সংগ্রহ ও পশুপাখি শিকার করত এবং নদীনালা, খালবিল হতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। এ সমাজের মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না, প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করত। তাই এ অর্থনীতিকে খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি বলা হয়।

এ সমাজে সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না, ছিল সামাজিক মালিকানা। আর এজন্য এ সমাজ ছিল শ্রেণিহীন । এ সমাজে খাদ্য ছিল অপ্রতুল। এ সময় কোনো বাড়তি খাবার জমা রাখার চিন্তাই করা হতো না। শিকারে যা পাওয়া যেত সবাই মিলে একসঙ্গে ভূরিভোজন করত, নয়তো সবাই একসঙ্গে উপোস করে থাকত। আদিম সমাজে প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ দেখা যায়। টাকাপয়সা, লেনদেন, হাটবাজার বলতে কিছুই ছিল না। তবে তাদের মধ্যে বিনিময় প্রথা বিদ্যমান ছিল।

প্রশ্ন-৩. সমাজ উৎপত্তি বিষয়ে সর্বপ্রাচীন মতবাদটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সমাজ উৎপত্তি বিষয়ে সর্বপ্রাচীন মতবাদ হচ্ছে ঐশ্বরিক মতবাদ। ঐশ্বরিক মতবাদ অনুসারে সমাজ হলো ঈশ্বরের সৃষ্টি। বিশ্বের যাবতীয় প্রাণী, প্রাণহীন বস্তু যা কিছু আছে সবকিছু একমাত্র ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, বিশ্বের যাবতীয় বস্তুর মতো সমাজও ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। কালক্রমে বিভিন্ন ধ্যানধারণা, চিন্তাচেতনায় বিকাশের ফলে এ মতবাদ অযৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়। ঐশ্বরিক মতবাদ যুক্তির বিচারে নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি।

প্রশ্ন-৪. সমাজ উৎপত্তির বলপ্রয়োগ মতবাদটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সমাজ উৎপত্তির একাধিক মতবাদের মধ্যে বলপ্রয়োগ মতবাদ অন্যতম। সমাজ উৎপত্তির বলপ্রয়োগ মতবাদ অনুসারে শক্তি বা বলপ্রয়োগই হলো সমাজ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। আদিম সমাজ ব্যবস্থায় বলবান ব্যক্তি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করত।

এ শক্তিমান ব্যক্তির অধীনে সমাজের অন্যরা সংগঠিত হয়ে বসবাস করতে বাধ্য হতো। ফলে বলবান ব্যক্তির বলপ্রয়োগের ফলে সৃষ্টি হয়েছে সমাজ। তাই বলপ্রয়োগকেই সমাজ সৃষ্টির একমাত্র কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু কালক্রমে এ মতবাদটি সমাজের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারেনি।

প্রশ্ন-৫. সভ্যতা বলতে কী বুঝ?

উত্তর: সভ্যতা বলতে মানব সংস্কৃতির একটি উন্নত পর্যায়কে বোঝায় যা নগর জীবনের উদ্ভবের সাথে সাথে উন্মেষ হয়েছে এবং যে পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। সাধারণ অর্থে সভ্যতা বলতে বস্তুগত বিষয় বা বাহ্যিক অবস্থাকে বোঝায়। সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হলো যাবতীয় পার্থিব ও শিল্প সম্পর্কিত ব্যবস্থাদি বা কলাকৌশল এবং মানবজীবনকে প্রভাবিত করে এমন যাবতীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।

প্রশ্ন-৬. সংস্কৃতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর: সংস্কৃতি বলতে মানুষের সার্বিক জীবনপ্রণালিকে বোঝায়। সাধারণ অর্থে সংস্কৃতি বলতে ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা প্রভৃতি চর্চাকেই বোঝায়। কিন্তু সংস্কৃতির সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এ থেকে ভিন্ন। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানষ যা কিছু করে তাই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর বলেন, “সংস্কৃতি হচ্ছে সেই জটিল ব্যবস্থা যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সমাজবাসীর জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, শিল্প আইন, নীতিকথা, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস, মূল্যবোধ প্রভৃতি; এগুলো সমাজবাসী সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জন করে থাকে।”

প্রশ্ন-৭. ‘সংস্কৃতি ও সভ্যতা একটি অপরটির পরিপূরক’— ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সম্পর্কের দিক থেকে সংস্কৃতি ও সভ্যতা একটি অপরটির পরিপূরক। সংস্কৃতি ও সভ্যতা মূলত মানুষের সৃষ্টি এবং এই সৃষ্টির দুটো দিক রয়েছে। যথা— বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত দিক যা সভ্যতা ও সংস্কৃতি নামে অভিহিত এবং তাদের একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করা যায় না। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে সংস্কৃতির যেমন উন্নতি সাধিত হয়, ঠিক তেমনি সভ্যতার অবদানকে উপেক্ষা করে সংস্কৃতি নিজেকে বিকশিত করে না। আর এ জন্যই বলা হয়, সংস্কৃতি ও সভ্যতা একে অপরের পরিপূরক।

প্রশ্ন-৮. অবস্তুগত সংস্কৃতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর: সংস্কৃতির যে উপাদান ধরাছোঁয়ার বাইরে, বাহ্যিক অস্তিত্বহীন এবং পরিমাপযোগ্য নয় তাকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বলে। অবস্তুগত সংস্কৃতির উপস্থিতি ও এর প্রভাব ব্যক্তিজীবনে ব্যাপক। মানুষের ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা, চলন-বলন, কথন, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আবেগ, উচ্ছ্বাস ইত্যাদি অবস্তুগত সংস্কৃতিকে নির্দেশ করে। অবস্তুগত সংস্কৃতির উদাহরণ হলো— ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন, ধর্ম ইত্যাদি।

প্রশ্ন-৯. প্রতিষ্ঠান বলতে কী বুঝ?

উত্তর: প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সামাজিক জীবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত সম্পর্কের ধরন। আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেরি মর্গানের মতে, “মানুষের চিরন্তন অভাব অভিযোগ প্রতিষ্ঠানকে জন্ম দিয়েছে।” সমাজবিজ্ঞানী পি. গিসবার্ট প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা প্রদানে বলেন, “প্রতিষ্ঠান হলো কতকগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিব্যবস্থা, যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।”

সমাজবিজ্ঞানী হার্টারলার-এর মতে, প্রতিষ্ঠান মূলত নয় প্রকার। যথা- ১. অর্থনৈতিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান; ২. বৈবাহিক ও গৃহস্থালি প্রতিষ্ঠান; ৩. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান; ৪. নৈতিক প্রতিষ্ঠান; ৫. শিক্ষামূলক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান; ৬. যোগাযোগকারী প্রতিষ্ঠান; ৭. নান্দনিক ও অভিব্যক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান; ৮. স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান; ৯. অবসর বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্ন-১০. সম্প্রদায় বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে একটি জনগোষ্ঠীর সুসংহত জীবনযাপনকে সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যখন কোনো ক্ষুদ্র বা বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের মৌল এবং সাধারণ স্বার্থগুলো একই সাথে ভোগ করে একই আচার-আচরণ, প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও জীবনযাত্রা প্রণালিতে অভ্যস্ত থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় বসবাস করে তখন ঐ জনগোষ্ঠীকে আমরা সম্প্রদায় বলতে পারি। যেমন – জেলে সম্প্রদায়, তাঁতি সম্প্রদায়, দলিত সম্প্রদায় ইত্যাদি।

প্রশ্ন-১১. সম্প্রদায়ের ভিত্তিসমূহ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সম্প্রদায়ের দুটি মৌলিক ভিত্তি রয়েছে। যথা— বসবাসের অঞ্চল ও সম্প্রদায়গত চেতনা। সম্প্রদায় সাধারণত একটি এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। আধুনিককালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সম্প্রদায়কে বিশেষ নো এলাকায় সীমাবদ্ধ না রাখলেও বলা যায় যতটুকু নিয়ে তার যোগাযোগ ততটুকু নিয়েই তার সম্প্রদায় এলাকা। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেন, সম্প্রদায়গত মানসিকতা তথা একই সঙ্গে বসবাস করার প্রবণতা না থাকলে তা সম্প্রদায় হতে পারে না।

প্রশ্ন-১২. মুখ্য দল ও গৌণ দলের পার্থক্য বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর: গঠনগত ও কার্যক্রমের দিক থেকে মুখ্য দল ও গৌণ দলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যে দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ, নিবিড় ও মুখোমুখি সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে মুখ্য দল বলে। পক্ষান্তরে যে দলের সদস্যদের মধ্যে নিয়মানুগ, প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক বিরাজ করে তাকে গৌন দল বলে।

প্রাথমিক দলের সদস্যদের মাঝে ‘আমরা ভাব’ বিদ্যমান থাকে। কিন্তু গৌণ দলে এরূপ মনোভাব থাকে না। প্রাথমিক বা মুখ্য দলের গণ্ডি বেশ সীমিত। পক্ষান্তরে গৌণ দলের গণ্ডি অনেক বৃহৎ এবং এর উদ্দেশ্য ও কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত।

প্রশ্ন-১৩. গৌণ দল বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: যে দলের সদস্যদের মধ্যে অনেকটা আনুষ্ঠানিক নীতিমালার দ্বারা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকে গৌণ দল বলে। এ দলের গণ্ডি বেশ বৃহৎ এবং এর উদ্দেশ্য ও কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত। এ দল প্রাথমিক দলের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে না। কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে গৌণ দলের সদস্যরা একত্রিত হয়। গৌণ বা মাধ্যমিক দলের সদস্যদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক হয় না। গৌণ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে পরোক্ষ এবং ব্যক্তি নিরপেক্ষ সম্পর্ক বিরাজ করে।

প্রশ্ন-১৪. সংঘ বলতে কী বোঝ? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সমাজের সদস্যবৃন্দ স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়ে সমষ্টিগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস চালালে তাকে সংঘ বলে। সংঘ প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার ও পেজ, মরিস জিন্সবার্গ, জিসবার্ট প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানী প্রামাণ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, সংঘ হচ্ছে গুপ্ত বা বৃহৎ এমনটি মানব সংগঠন, যা সুনির্দিষ্ট এবং অভিন্ন লক্ষ্য বা সুবিধা অর্জনের জন্য একত্রিত হয়। আবার লক্ষ্য অর্জনের পর তারা সংগঠিত থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে।

প্রশ্ন-১৫. লোকরীতি বলতে কী বোঝায়? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: লোকরীতি হচ্ছে সমাজের আদর্শ বা মানসম্পন্ন আচরণ যা সমাজের সদস্যদের জন্য অবশ্য পালনীয়। অর্থাৎ- যে সমস্ত লোকরীতি সমাজের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন এবং যেগুলো পালিত না হলে সমাজের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে সে সমস্ত রীতিনীতিকে অবশ্য পালনীয় লোকরীতি বলে। লোকরীতি অপেক্ষাকৃত স্থায়ী প্রকৃতির ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জামা-কাপড় পরে সমাজে চলাফেরা করাটা লোকরীতি।

প্রশ্ন-১৬. প্রথা বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: প্রথা হচ্ছে সামাজিক জীবন অতিবাহিত করার কতগুলো অনুশাসন যা অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীল ও ব্যক্তির আচার- ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকেই কতকগুলো প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত নিয়মানুযায়ী আচার-আচরণ পালন করতে হয়। প্রথা হলো একটি ব্যাপক প্রত্যয়, যা সমস্ত আদর্শ, লোকাচার ও লোকরীতির সমন্বয়। অর্থাৎ সামাজিক প্রথা হলো চিন্তা ও সামাজিক আচরণ প্রকাশের প্রতিষ্ঠিত প্রণালি।

প্রশ্ন-১৭. ‘প্রথা মূলত সামাজিক’— বুঝিয়ে লিখ।

উত্তর: প্রথা উদ্ভবের মূল উপাদান সমাজ থেকে সৃষ্ট বলে একে অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক প্রত্যয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সব সমাজেই মানুষের আচার-আচরণের কতগুলো সুনির্দিষ্ট ধারা বা রীতি লক্ষ করা যায়। এগুলোকে প্রথা বলা হয়। সমাজবদ্ধভাবে বসবাসকারী মানুষমাত্রই সমাজে প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত এসব রীতিকে অনুসরণ করে।

সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখার জন্য এবং মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার তাগিদে এসব রীতিনীতি বা প্রথার উদ্ভব হয়েছে। কার্যত সমাজবদ্ধ মানুষের অভ্যাসগত কার্যধারাই কালক্রমে সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল যে, প্রথার উদ্ভব এবং প্রয়োগ পুরোটাই সমাজের প্রয়োজনে। এ কারণেই বলা হয়, ‘প্রথা মূলত সামাজিক’।

প্রশ্ন-১৮. সমাজকাঠামো বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সমাজকাঠামো বলতে সমাজের ক্রিয়াশীল পূর্বশর্তসমূহকে ঘিরে সৃষ্ট প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর যৌগিক সম্পর্ক ও ভূমিকাকে বোঝায়। প্রত্যেক সমাজেরই একটি সাংগঠনিক আকৃতি বা ধরন থাকে। এই সাংগঠনিক ধরনটি সৃষ্টি হয় সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সংযোজন ও সহযোগিতা সূত্রে সৃষ্ট বিভিন্ন কাঠামোকে নিয়ে। অর্থাৎ সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে যে সাংগঠনিক রূপ গড়ে তোলে তাকেই সমাজকাঠামো বলে।

প্রশ্ন-১৯. ‘সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন’— ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: অমার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, শ্রেণিহীন সমাজ কল্পনামাত্র। অর্থাৎ সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো চিরন্তন ও সর্বজনীন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কোনো সমাজ-ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় না, যা পরিপূর্ণভাবে সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

সমাজজীবনের সূচনা থেকেই সামাজিক স্তরবিন্যাসের উদ্ভব ঘটেছে এবং কখনো অবলুপ্ত হয়নি। স্তরবিন্যাসকে বাস্তবে কখনো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনের ধারায় সামাজিক স্তরবিন্যাসের আকৃতি- প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু স্তরবিন্যাস কখনো বিলুপ্ত হয়নি।

প্রশ্ন-২০. সামাজিক গতিশীলতার ধরনগুলো ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সামাজিক গতিশীলতাকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা— আনুভূমিক ও উল্লম্বী। সাধারণত এক সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে অন্য সামাজিক পরিমণ্ডলে একই সামাজিক স্তরে ব্যক্তির স্থায়ী গমনকে আনুভূমিক গতিশীলতা বলে। আর উল্লম্বী গতিশীলতা হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাসের উঁচু অথবা নিচু অবস্থানে গমন করা।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনোরূপ বেতন কিংবা পদমর্যাদার পরিবর্তন ছাড়াই এক প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের চাকরি গ্রহণ হচ্ছে আনুভূমিক গতিশীলতা। অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে কলেজের প্রভাষকের চাকরি গ্রহণ হচ্ছে উল্লম্বী গতিশীলতা।

প্রশ্ন-২১. উচ্চস্তরের কাজ সম্পাদনের সামর্থ্যের অভাব সামাজিক গতিশীলতা সৃষ্টি করে কেন?

উত্তর: উচ্চস্তরে কাজ সম্পাদনের সামর্থ্যের অভাবে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক শ্রেণিতে সবসময় অবস্থান করা যায় না বলে সামাজিক গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, উচ্চস্তরের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকে নানা কারণে সংশ্লিষ্ট স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম বা সফল হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতে তাদের সামাজিক মান- মর্যাদার হানি ঘটে এবং তারা সামাজিক গতিশীলতার নিম্নস্তরে নেমে আসে।

প্রশ্ন-২২. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। বস্তুত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে সমাজ কর্তৃক গৃহীত এমন সব পন্থা, ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার সাহায্যে ব্যক্তির কাজকর্ম, তার চলন- বলন-কথন-ব্যবহার ইত্যাদি সমাজ কর্তৃক কাঙ্খিত ধারায় পরিচালিত করা যায়। যেমন— দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। সুতরাং বলা যায়, সমাজের সদস্যবৃন্দ সমাজ স্বীকৃত পন্থায় কাঙ্খিত আচরণ করবে এমন নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যবস্থা এবং প্রক্রিয়াই হচ্ছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ।

প্রশ্ন-২৩. সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে নগরায়ণের প্রভাব ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: নগরায়ণ হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নগরের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটে। নগরায়ণের ফলে মানুষ ক্রমাগত গ্রাম থেকে নগরের দিকে ধাবিত হয়। মানুষের মনে নগর মানসিকতা গড়ে ওঠে। নগরে বসবাসকারী মানুষের জীবনপ্রণালি গ্রামীণ জীবনপ্রণালি থেকে ভিন্নতর। নগর মানসিকতা নগরবাসীর কাজকর্মে, আচরণ-চিন্তায়, এক কথায় মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটায়। বিভিন্ন পেশার সুযোগ থাকায় নগরবাসীর আর্থসামাজিক তথা মর্যাদাগত পরিবর্তন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এভাবে সামাজিক গতিশীলতা বাড়ে।


আশাকরি “সামাজিক প্রতিষ্ঠান – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৪র্থ অধ্যায় সমাধান” আর্টিকেল টি তোমাদের ভালো লেগেছে। সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র সকল অধ্যায় এর প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Comment