সামাজিক স্তরবিন্যাস ও অসমতা – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৮ম অধ্যায়

সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৮ম অধ্যায়: মানবসমাজ সহজাতভাবে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে সামাজিক স্তরবিন্যাস পরিলক্ষিত হয় না। স্তরবিন্যাসের রূপ ও প্রকৃতি যুগে যুগে বদল হলেও সব সমাজেই সামাজিক অসমতার অস্তিত্ব ছিল।

সাধারণত অর্থ, ক্ষমতা, সম্পদ প্রভৃতির দিক থেকে সমাজের সদস্যদের মধ্যে যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তাকেই সামাজিক অসমতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বর্তমান অধ্যায়ে সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকারভেদ, মতবাদ, সামাজিক অসমতার উৎপত্তি, প্রকারভেদ, জেন্ডার ও বয়স বৈষম্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়াদি আলোচনা করা হয়েছে।


সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৮ম অধ্যায়

প্রশ্ন-১. সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সমাজের উঁচু-নিচু বিভিন্ন শ্রেণি বা মর্যাদার মানুষকে বোঝাতে সমাজবিজ্ঞানে যে প্রত্যয়টি গৃহীত হয়েছে তা সামাজিক স্তরবিন্যাস হিসেবে পরিচিত। এটা এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে মর্যাদা, শ্রেণি ও অন্যান্য আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত করা হয়। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন ও নিমকফ সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা প্রদানে বলেন, “স্তরবিন্যাস হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে মোটামুটি স্থায়ীভাবে উঁচু-নিচু মর্যাদার ক্রমানুসারে সাজানো হয়।”

প্রশ্ন-২. “সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে এক ধরনের বাজার ব্যবস্থা”- ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক ও আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ডেভিস (Kingsley Davis) এবং ম্যুরের (Wilbert E. Moore ) মতে সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে এক ধরনের বাজার ব্যবস্থা। বাজারে যেমন দুষ্প্রাপ্য পণ্যের সরবরাহ কম কিন্তু চাহিদা ও মূল্য বেশি, ঠিক তেমনি সমাজের চাহিদা অনুযায়ী মেধাবী ও দক্ষ লোকের সরবরাহ কম বলে তাদেরকে বেশি পারিশ্রমিক, ক্ষমতা এবং মর্যাদা দিতে হবে।

তাদের যুক্তি হচ্ছে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে হলে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে স্বীকার করতে হবে। তাদের মতে, সামাজিক অসমতা বা বৈষম্যগুলো সমাজে অচেতনভাবে বা অজান্তেই সৃষ্টি হয়। তার কারণ হচ্ছে সমাজে বিভিন্ন স্তরের কাজ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে মেধা এবং যোগ্যতার পার্থক্য। বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগ দিতে হয়। তাই আমরা না চাইলেও সমাজে স্তরবিন্যাস সক্রিয়ভাবেই সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন-৩. ‘সকল সমাজই ছিল স্তরায়িত’— ব্যাখ্যা করো।
অথবা ‘সামাজিক স্তরবিন্যাস সৰ্বজনীন’— কথাটি বুঝিয়ে লিখ।
অথবা ‘সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বত্র লক্ষণীয়’— ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: সামাজিক স্তরবিন্যাস চিরন্তন ও সর্বজনীন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কোনো সমাজ খুঁজে পাওয়া যায় না, যা পরিপূর্ণভাবে সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আদিম অধিবাসীদের গোষ্ঠীজীবনেও দলপতির প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কেন্দ্র করে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি অধিকতর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত।

কালের বিবর্তনের ধারায় সামাজিক স্তর বিন্যাসের আকৃতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু স্তরবিন্যাস কখনও বিলুপ্ত হয়নি। সকল সমাজেই এটি বিদ্যমান। এ জন্যই বলা হয়, ‘শ্রেণিহীন সমাজ অলীক কল্পনামাত্র।’ অর্থাৎ মানব সমাজ থেকে স্তরবিন্যাস কখনই অবলুপ্ত হয়নি।

প্রশ্ন-৪. দাসপ্রথা বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: দাসপ্রথা বলতে এমন এক অসম সামাজিক প্রথা বা ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে কিছু লোক সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে অধিকারবিহীন। ব্রিটিশ উদারপন্থী সমাজতাত্ত্বিক এল. টি. হবহাউস (Leonard Trelawny Hobhouse) দাসের সংজ্ঞা প্রদানে বলেন, “দাস হচ্ছে এমন একজন মানুষ আইন এবং প্রথা যাকে বিশুদ্ধ অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে।” মানুষকে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখার এ নিয়ম পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। ঘৃণ্য এ প্রথা অনুযায়ী একজন দাস ছিল তার প্রভু বা মনিবের সম্পত্তি।

মুক্ত বা স্বাধীন মানুষের মতো দাসদের কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। পাশ্চাত্য সমাজেই (প্রাচীন গ্রিস, রোম, মধ্যযুগের আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলো) দাসপ্রথার চরম রূপ বিদ্যমান ছিল। ভারতবর্ষে ও মধ্যপ্রাচ্যেও দাসপ্রথা ছিল। তবে এখানে দাসদের সাথে অমানবিক আচরণ তুলনামূলক কম করা হতো।

প্রশ্ন-৫. ভারতীয় সমাজে দাসব্যবস্থাকে ‘Domestic Slavery’ বলা হতো কেন?

উত্তর: বিশ্বের বিভিন্ন সমাজেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। তবে বিভিন্ন সমাজের দাসব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য ছিল। প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। তবে তা পাশ্চাত্যের দাসপ্রথার ন্যায় ছিল না। এদেশের দাসেরা সাধারণত গৃহকাজে নিয়োজিত ছিল। এদেরকে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হতো না।

আর্যদের আগমনের সময় ভারতে দাসব্যবস্থার পত্তন হয়। কিন্তু গ্রিক ও রোমান সমাজের মতো ভারতীয় দাসদের সাথে ততটা অমানবিক আচরণ করা হতো না। এদেরকে গৃহকাজেই বেশি ব্যবহার করা হতো। এজন্য ভারতীয় সমাজে দাসব্যবস্থাকে ‘Domestic Slavery’ বলা হতো।

প্রশ্ন-৬. এস্টেট প্রথা বলতে কী বোঝ?

উত্তর: সামাজিক স্তরবিন্যাসের যেসব ধরন রয়েছে তার মধ্যে এস্টেট প্রথা অন্যতম। এটা পশ্চিম ইউরোপের বিশেষ করে ফ্রান্সের সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত একটি বিশেষ শ্রেণি। মধ্যযুগে ইউরোপে এস্টেটগুলোর তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। যেমন- ক. প্রত্যেক এস্টেটের একটি পদমর্যাদা ছিল যার অধিকার, কর্তব্য, সুযোগ-সুবিধা ও বাধ্যবাধকতা আইনসম্মত। খ. এস্টেটগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক শ্রমবিভাজন প্রতিফলিত হয় এবং প্রতিটি এস্টেটের সুনির্দিষ্ট কতগুলো কর্তব্য ছিল। গ. সামন্ততান্ত্রিক এস্টেটসমূহ ছিল এক একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী।

প্রশ্ন-৭. শ্রেণি বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: শ্রেণি বলতে একই আয়, একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী গোষ্ঠীকে বোঝায়। সাধারণ অর্থে শ্রেণি বলতে আমরা বুঝি এমন একটি জনসমষ্টিকে যাদের একটি সামাজিক অবস্থান বিদ্যমান এবং মোটামুটি একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। শ্রেণি আপেক্ষিক অর্থে মুক্ত। এটা কোন বদ্ধ ব্যবস্থা নয়। তাই এক শ্রেণি ক্রমে অন্য শ্রেণিতে পরিণত হতে পারে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে শ্রেণির ভিত্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক বা আয়ের বৈষম্য। তবে শ্রেণি বলতে অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর চেয়ে অধিক আরও কিছু বোঝায়, যেমন— পদমর্যাদাভেদে শ্রেণির বিভিন্নতা।

প্রশ্ন-৮. সামাজিক মর্যাদা বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: কোনো সমাজের সদস্যের আয়, মর্যাদা, শিক্ষা, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার ভিত্তিতে ব্যক্তির যে সামাজিক অবস্থান তাই সামাজিক মর্যাদা। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী টি বি বটোমোর বলেন, ‘মর্যাদার ভিত্তি হলো দ্রব্যসামগ্রীর ভোগ এবং জীবনযাত্রার ধরন কেমন সেটাই।’ সমাজের মানুষের কাছে কোনো ব্যক্তির অবস্থান কেমন সেটাই তার মর্যাদা। সামাজিক মর্যাদা শ্রেণির ওপর নির্ভর করে।

প্রশ্ন-৯. সামাজিক অসমতা বলতে কী বোঝ? বুঝিয়ে লেখ।

উত্তর: সমাজস্থ কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্যের অভাবই সামাজিক অসমতা। অসমতা বলতে সমতার অভাবকে বোঝায়। মানুষের পদমর্যাদা, ক্ষমতা, সম্পদ, সুযোগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অসম ও অনাকাঙ্ক্ষিত পার্থক্যই হলো অসমতা। মানবসমাজ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়ের ভিত্তিতে বিভাজিত । মানবসমাজের এ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভাজন সমাজজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়।

প্রশ্ন-১০. সামাজিক বৈষম্য বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সামাজিক বৈষম্য বলতে প্রাতিষ্ঠানিক অসমতাকেই বোঝায়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসরত দুই বা ততোধিক জনগোষ্ঠীর মর্যাদা, শ্রেণি, বর্ণপ্রথা এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে একে অন্যের থেকে ভিন্ন হয়। যখন একটি গোষ্ঠীর সাথে অন্য একটি গোষ্ঠীর তুলনা করা হয় তখন তাদের মাঝে সুযোগ-সুবিধা, দান-অনুদান, বিধিনিষেধ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তাকেই সামাজিক বৈষম্য বলে।

প্রশ্ন-১১. ‘বয়স সামাজিক অসমতার অন্যতম নির্ধারক’— ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: বয়স সামাজিক অসমতার অন্যতম নির্ধারক কেননা বয়সভেদে সামাজিক অসমতা সৃষ্টি হয়। বয়সের ভিত্তিতে সমাজের মানুষকে শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ- এই চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। বয়সের ভিত্তিতে সৃষ্ট সামাজিক অসমতার সাথে সামাজিক মূল্যবোধের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। আমাদের সমাজে সাধারণত শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধদের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অধিকাংশ সময় এ বৈষম্য বয়সের কারণেই সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন-১২. আরোপিত ও অর্জিত মর্যাদা বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সমাজের মানুষের কাছে কোনো ব্যক্তির অবস্থান কেমন সেটাই তার মর্যাদা। সমাজ যখন ব্যক্তির গায়ের রং বা চেহারা, বংশ বা স্ত্রী-পুরুষ ভেদ ইত্যাদির ভিত্তিতে কাউকে মর্যাদা প্রদান করা হয় তখন তাকে আরোপিত মর্যাদা বলে। আর সমাজ যখন ব্যক্তির কাজকর্ম, যোগ্যতা বা পারদর্শিতার ভিত্তিতে মর্যাদা প্রদান করে তখন তা হবে ব্যক্তির অর্জিত মর্যাদা। যেমন: শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার ইত্যাদি অর্জিত মর্যাদার উদাহরণ।

প্রশ্ন-১৩. ‘সামাজিক শ্রেণি উন্মুক্ত ব্যবস্থা’—ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: শ্রেণি অর্জিত সামাজিক অবস্থান বলে এটি একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা। সমাজে সুনির্দিষ্ট মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমষ্টিই হচ্ছে শ্রেণি। সামাজিক পরিমাপে শ্রেণির অবস্থান মর্যাদার সাথে সম্পর্কযুক্ত। শ্রেণি মূলত আয়, ক্ষমতা, সম্পত্তি, পেশা, শিক্ষা ও বংশ মর্যাদার উপর নির্ভর করে। ব্যক্তি নিজের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে সামাজিক অবস্থা নির্ণয় করতে পারে। এ কারণেই মূলত শ্রেণিকে উন্মুক্ত ব্যবস্থা বলা হয়।

প্রশ্ন-১৪. ‘বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে সামাজিক অসমতা দেখা দেয়’— বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর: বুদ্ধিমত্তা সামাজিক অসমতার অন্যতম নির্ধারক। কেননা বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, ধীশক্তি এগুলোর ভিত্তিতে সমাজের মানুষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণীত হয় এবং সামাজিক অসমতা দেখা দেয়। এরিস্টটলের মতে, জন্মগতভাবেই মানুষ প্রজ্ঞাবান ও প্রজ্ঞাহীন হয় এবং বুদ্ধিমত্তার এরূপ পার্থক্যের জন্যেই সমাজে দাস ও মনিবের সৃষ্টি হয়। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে যে সামাজিক শ্রেণিসমূহের কথা বলা হয়েছে তা মূলত বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য থেকেই সৃষ্ট।

প্রশ্ন-১৫. সামাজিক অসমতা নির্ণয়ের জৈবিক উপাদান বলতে কী বোঝ?

উত্তর: সামাজিক অসমতা নির্ধারকসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: জৈবিক বা প্রাকৃতিক উপাদান এবং সামাজিক উপাদান। জৈবিক বা প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে নারী-পুরুষের অসমতা, বয়স, জাতি, বর্ণগত, নরগোষ্ঠীগত, বংশ মর্যাদাগত ইত্যাদি উপাদানগুলো উল্লেখযোগ্য। জৈবিক উপাদান মানুষের মধ্যে এমনি এমনিভাবে আসে। এগুলো মানুষ ইচ্ছা করলে বাদ দিতে বা পরিবর্তন করতে পারে না। কেননা সমাজে বসবাসকারী মানুষই এসব জৈবিক উপাদানকে মূল্যায়ন করে।

প্রশ্ন-১৬. “লিঙ্গ সামাজিক অসমতার অন্যতম নির্ধারক বা উপাদান” ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: নারী ও পুরুষের মধ্যে জীববিজ্ঞানের নিয়মে যে পার্থক্য তাকে লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ লিঙ্গ পার্থক্যের জন্যেই মানবজাতির দুই অংশের একটি পুরুষ এবং অপরটি নারী। প্রাকৃতিক কারণে এই অসমতার উদ্ভব হলেও সমাজজীবনের ক্ষেত্রে এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

পুরুষ ও নারীর লিঙ্গ ভেদাভেদের দোহাই দিয়ে সমাজ নারী ও পুরুষের কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরি করে পুরুষ প্রাধান্য সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে পুরুষশাসিত সমাজের উদ্ভব হয়। পুরুষরা হয়ে পড়ে নারীর অভিভাবক এবং নারীর সকল কাজের কৈফিয়ত গ্রহণকারী। তাই বলা যায়, লিঙ্গ সামাজিক অসমতার অন্যতম নির্ধারক বা উপাদান।

প্রশ্ন-১৭. জেন্ডার বলতে কী বোঝ?

উত্তর: জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা নারী-পুরুষের পরিচয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক, সমাজ কর্তৃক আরোপিত নারী-পুরুষের ভূমিকা যা পরিবর্তনীয়। নারী ও পুরুষ সম্বন্বীয় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকবোধ হচ্ছে জেন্ডার যা স্থান কালভেদে পরিবর্তিত হয়। সমাজে নারী ও পুরুষের কার কী রকম পোশাক-পরিচ্ছদ হবে, সে কী রকম আচার-আচরণ করবে, আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা কার কী রকম হবে তা প্রকাশ করে জেন্ডার। এছাড়াও জেন্ডার সমাজে একজন নারী বা একজন পুরুষের ভূমিকা কী তা নির্ধারণ করে।

প্রশ্ন-১৮. ‘জেন্ডার ধারণা শ্রমমূল্য এবং চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে’— বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর: বাংলাদেশের মতো দেশসমূহে জেন্ডার বিশেষে শ্রমিকের শ্রমমূল্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায় । আমাদের সমাজে বিভিন্ন পেশায় মেয়েরা পুরুষের তুলনায় কমমূল্যে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্রেও জেন্ডার বৈষম্য চোখে পড়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় সকল কর্মক্ষেত্রে পুরুষরা বেশি অগ্রাধিকার পায়। এছাড়া অনেক কাজে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়। যেমন: নিরাপত্তাকর্মী, নৈশ প্রহরী, ড্রাইভার ইত্যাদি পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ খুব কম।

প্রশ্ন-১৯. জেন্ডার ধারণাটি বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে জেন্ডারগত সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলেই জেন্ডার ধারণাটি বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক সভ্য সমাজে জেন্ডার বৈষম্যের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে এটা বেরিয়ে আসে যে, নারী ও পুরুষ উভয়ের অর্থনৈতিক মূল্য এখন বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর জেন্ডার সমতা অবধারিতভাবে লাগাতার প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। এ কারণে প্রায় সকল সভ্য সমাজেই এখন জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে জেন্ডার প্রত্যয়ের যুগোপযোগী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন-২০. জেন্ডারের ভিত্তিতে সৃষ্ট জন্মগত বৈষম্যের ধারণা দাও।

উত্তর: জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা নারী-পুরুষের পরিচয়। জেন্ডারের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় নানাবিধ সামাজিক বৈষম্য। জন্মগত বৈষম্য সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে জন্ম নেওয়া সন্তানের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য চোখে পড়ে। যেমন একটি পুত্র সন্তান হলে তারা যেরূপ আনন্দচিত্তে ও আগ্রহভরে তাকে নিয়ে নানান রঙিন স্বপ্ন দেখে, একটি কন্যা সন্তান হলে তাদের মধ্যে সেই আনন্দ ও আগ্রহ দেখা যায় না। বরং তারা মনে কষ্ট পায় এবং কন্যাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়ে।

প্রশ্ন-২১. বয়স বৈষম্যবাদ বলতে কী বুঝায়?

উত্তর: বয়স বৈষম্যবাদ বলতে কেবল বয়সের কারণে কোনো বয়স গোষ্ঠী বা তার কোনো সদস্যের প্রতি নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা বা মনোভাবপোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ করাকে বুঝায়। বয়স বিদ্বেষী ব্যক্তি বা সমাজ প্রবীণদেরকে জৈবিক ও সামাজিকভাবে অযোগ্য বলে মনে করে। তাদেরকে বিচ্ছিন্ন, নির্ভরশীল, আবেগীয় দিক থেকে অস্থিতিশীল এবং দুর্বলচিত্তের অধিকারী বলে গণ্য করে। আর এ ধরনের মনোভাব থেকেই প্রবীণদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ তৈরি হয়।

প্রশ্ন-২২. “অবসর গ্রহণ হচ্ছে বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক পরিণতি’— অবসর গ্রহণ তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: অবসর গ্রহণ তত্ত্বের উদ্ভাবক কামিং এবং হেনরি। এ তত্ত্বে তারা বলেন— বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় মানুষ যতই বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলে ততই ক্রমে তার যুব বয়স তথা মধ্যবয়সের সামাজিক কাজকর্ম কমিয়ে দেয় এবং অনেক কাজই ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে অবসর নিতে থাকে।

পাশাপাশি ঐ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে বা নিজের একান্ত সমস্যাবলি নিয়েই ভাবতে শুরু করে। কামিং এবং হেনরির যুক্তি হলো, যেহেতু বার্ধক্যে পৌঁছলে মানুষ ক্রমেই মৃত্যু সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে এবং যেহেতু তাদের কর্মশক্তি কমে আসে এবং তাদের কাজের কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে ভাটা পড়তে থাকে; ফলে সে আস্তে আস্তে বিভিন্ন কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে। অর্থাৎ অবসর গ্রহণ হচ্ছে বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক পরিণতি।

প্রশ্ন-২৩. সক্রিয়তা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: সক্রিয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী যখন প্রবীণেরা তাদের সামাজিক ভূমিকা ও কাজকর্ম পরিত্যাগ করেন তখন তারা নিজেদেরকে কোথাও যেন হারিয়ে ফেলার বেদনা বুঝতে থাকেন, তারা নিজেদের ‘বহিষ্কৃত’ ভেবে মনে মনে আহত হন। এবং নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেন।

তারা যাতে মানসিক শক্তি হারিয়ে দুর্বল না হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারেন, সেজন্য তাদেরকে অবসর গ্রহণের বিপরীত কাজটি করতে হবে। অর্থাৎ তারা অবশ্যই Re-engage বা পুনরায় কর্মজগতে অনুপ্রবেশ করবেন এবং নিজেদের কর্মময় জীবন ফিরিয়ে আনবেন।

প্রশ্ন-২৪. প্রবীণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দাও।

উত্তর: পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজে প্রবীণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হলো নির্দিষ্ট একটি বয়সে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান। বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের যুক্তি হলো বাধকে কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়; প্রবীণদের অবসর প্রদান করলে নবীনদের জন্যে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির সুযোগ ঘটে।

আমাদের মতো সমাজের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য হলেও প্রথম যুক্তিটি কোনো সমাজেই সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কেননা কতিপয় নবীনের চেয়ে কতিপয় প্রবীণের কর্মক্ষমতা বরং বেশিই হতে পারে। অন্তত সমানতো বটেই।

প্রশ্ন-২৫. সামাজিক নিরাপত্তার ধারণাটি বুঝিয়ে বল।

উত্তর: সামাজিক নিরাপত্তা বলতে এমন এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে বোঝায় যা আধুনিক সমাজে অদৃষ্টপূর্বক এবং বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতিতে সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদান করা হয়। ব্যক্তি যে সমাজে বসবাস করে সেই সমাজের উচিত দেশের বাসিন্দা হিসেবে তার সকল সুযোগ-সুবিধাদি তৈরি ও তাকে সরবরাহ করা। সামাজিক নিরাপত্তা সরকারের সেই কার্যকরী কর্মসূচিকে নির্দেশ করে, যা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে।


আশাকরি “সামাজিক স্তরবিন্যাস ও অসমতা – সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র ৮ম অধ্যায়” আর্টিকেল টি তোমাদের ভালো লেগেছে। সমাজবিজ্ঞান ১ম পত্র সকল অধ্যায় এর প্রশ্নোত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Comment